সুলতানি আমলে বাংলার সামাজিক ও বিচার ব্যবস্থা

Follow Our Official Facebook Page For New Updates


Join our Telegram Channel!

প্রশ্ন : সুলতানি আমলে বাংলার বিচার ব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও [ফা. স্নাতক প. ২০১৬] (Social and judicial system of Bengal during the Sultanate period)

সুলতানি আমলে

উপস্থাপনা : 

১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খলজীর বাংলা বিজয়ের মাধ্যমে এতদঞ্চলে ইসলামী সালতানাত ব্যবস্থার সূচনা হয়। এরপর খলজী বংশ ও অন্যান্য শাসকগণ ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাকে দিল্লির অধীনে একটা প্রদেশ হিসেবে শাসনকার্য অব্যাহত রাখে। 

এ সময় বাংলাকে তিনটি ইকতা বা প্রদেশে ভাগ করে শাসন করা হতো। সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে এ তিনটি প্রাদেশে, 

একীভূত করে স্বাধীন সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন। ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে পরবর্তী দুশো বছর বাংলায় স্বাধীন সুলতানি শাসনব্যবস্থা বলবৎ ছিল।

সুলতানি বাংলার বিচার ব্যবস্থা : 

সুলতানি আমলে বাংলায় বিচারব্যবস্থা সুনিয়ন্ত্রিত ছিল। সুলতান ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারপতি। সপ্তাহের কয়েকটি বিশিষ্ট দিনে সুলতান নিজে বিচারকার্য সম্পাদন করতেন। 

কাজীর অবস্থান ছিল সুলতানের নীচে। প্রধান প্রধান শহরগুলিতেও কাজী নিযুক্ত হতেন। গ্রামাঞ্চলে হিন্দুদের মধ্যে ‘পঞ্চায়েত ব্যবস্থা' প্রচলিত ছিল।

১. সুলতান : 

সুলতান ছিলেন সর্বোচ্চ শাসক। তিনি রাজত্বসূচক উপাধি ধারণ করতেন, যেমন— ‘সুলতান-উল-আজম', 'সুলতান-উল-মুয়াজুম', 'সুলতানে বাংলা' প্রভৃতি। কোন কোন সুলতান 'খলিফা' উপাধিও ধারণ করতেন। রাজপ্রাসাদেই সুলতানের দরবার বসত। 

রাজপ্রাসাদ প্রহরীগণ কর্তৃক সুরক্ষিত থাকত। রাজপ্রাসাদে বহু উচ্চপদস্থ কর্মচারী নিযুক্ত হতেন, যথা— 'হাজিব', ‘শিলাদার’, ‘সরবদার' প্রভৃতি। এছাড়া বহু ক্রীতদাস রাজপ্রাসাদে নিযুক্ত থাকত। 

দুর্বল সুলতানদের আমলে ক্রীতদাসরা প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছিল এবং এদের মধ্যে অনেকে 'ওয়াজীর'-এর পদও লাভ করতেন। ইসলামী শাস্ত্রের অনুশাসন অনুসারে সুলতানরা শাসন ও বিচার করতেন। 

২. আমীর : 

আমীররা রাষ্ট্র-শাসন ব্যাপারে যথেষ্ট প্রভাব ও ক্ষমতা বিস্তার করতেন। এদের ভিতর থেকেই সুলতানের উপদেষ্টারা নিযুক্ত হতেন। সুলতানদের ব্যক্তিত্ব ও তাদের ক্ষমতা ও দুর্বলতা ওপর আমীরদের প্রভাব প্রতিপত্তি নির্ভর করত। 

দুর্বল সুলতানদের আমলে আমীররা প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা হয়ে উঠতেন। অনেক ক্ষেত্রে আমীররা নিজেদের মনোনীত প্রার্থীকে সিংহাসনে স্থাপন করতেন, এরকম বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। 

তবে সাধারণত রাজপরিবারের ভিতর থেকেই সুলতান মনোনীত হতেন ।

৩. ওয়াজীর : 

রাজস্ববিভাগর প্রধান কর্মচারী ছিলেন ‘ওয়াজীর'। তিনি অন্যান্য বিভাগের ওপরও কর্তৃক করার অধিকারী ছিলেন। ফিরিস্তা বলেন যে, দুর্বল সুলতানের আমলে ‘ওয়াজীর সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী হতেন। সাধারণত ক্ষমতাশালী আমীরকেই এই পদে নিযুক্ত করা হত ।

উপসংহার : 

সুবিচার লাভের জন্য নিপীড়িত জনগণ সুলতানের নিকট আবেদন জানাতে পারতো। গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের আমলে কাজীর বিচার সর্বজনবিদিত। কথিত আছে, একদিন শিকারের সময় একটি শর এক বিধবার ছেলেকে বিদ্ধ করে। 

বৃদ্ধা কাযীর নিকট নালিশ করলে কাযী সুলতানকে ডেকে বিচার করেন। সুলতান কাযীর আদেশ মেনে নেন এবং বলেন, কাযী সুবিচার না করলে তিনি তাকে কতল করতেন। প্রত্যুত্তরে কাযী বলেন, 

সুলতান যদি কাযীর বিচার মেনে না নিতেন তাহলে তিনি সুলতানকে বেত্রাঘাতের নির্দেশ দিতেন। পরিশেষে বলা যায়, সুলতানি আমলে বিচার ব্যবস্থা খুবই স্বচ্ছ ও ন্যায়ভিত্তিক ছিল।

প্রশ্ন : সুলতানি আমলে বাংলার সামাজিক অবস্থার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ [ফা. স্নাতক প. 2012]

উপস্থাপনা : 

মধ্যযুগে বঙ্গদেশে কোনো প্রামাণ্য ধারাবাহিক ইতিহাসের দলীল দস্তাবেজ না থাকায় এ ভূখণ্ডের সর্বাঙ্গীণ ইতিহাস রচনা সত্যিই কষ্টসাধ্য। 

বহু কষ্টে রাজাদের ঘটনা পরম্পরা নির্ণয় করা সম্ভব হলেও সে সময়কার রাষ্ট্রকাঠামো এবং জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে জানা যায় না। 

তবে দেশি বিদেশি বিভিন্ন সূত্র থেকে সুলতানি আমলে বাংলার আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে যৎসামান্য ধারণা করা যায়। 

ইবনে বতুতা, মাহুয়ান প্রমুখ পর্যটক বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা ও বাঙ্গালির জীবনযাত্রার চিত্র তাঁদের ভ্রমণ কাহিনীতে লিপিবদ্ধ করেন, 

যা সুলতানি আমলে বাংলার আর্থ-সামাজিক অবস্থা জানার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের বিবরণ অনুসারে তৎকালীন বাংলার আর্থ-সামাজিক অবস্থা ভালো ছিল । 

সুলতানি আমলে বাংলার সামাজিক অবস্থা:

সুলতানি আমলে বাংলায় প্রধানত দুটি সম্প্রদায়ের লোক বাস করতো। একটি রাজ ক্ষমতার অধিকারী মুসলিম সম্প্রদায়, অপরটি সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়। নিম্নে এ দুটি সম্প্রদায়ের সামাজিক অবকাঠামো তুলে ধরা হলো

১. মুসলিম সমাজ : 

সুলতানি আমলে বাংলায় ধীরে ধীরে এক একত্ববাদী সাম্যবাদী মুসলিম সমাজ গড়ে ওঠে। আর এটি সম্ভব হয়েছিল মুলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে। 

ঐতিহাসিকগণ মোটামুটিভাবে ঐকমত্যে পৌঁছেন যে, বাংলায় ইসলামী সালতানাত কায়েমের পূর্বাবধি এখানে কোনো মুসলিম বসতি গড়ে উঠেনি। সুলতানি আমলে বাংলায় বহু সাধকের আগমন ঘটে। 

তারা সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলার অভিবাসীদের মধ্যে ইসলামের বাণী প্রচার করেন। ইসলামের ঐকমত্যে সুমহান সাম্যের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদের নির্যাতনে নিষ্পেষিত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা দলে দলে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে দীক্ষিত হয়। 

ঐতিহাসিক ড. আবদুর রহিম প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, বাংলার মুসলিম অধিবাসীদের মধ্যে ৭০ ভাগ ধর্মান্তরিত, আর বাকি ৩০ ভাগ এসেছে বাইরে থেকে অর্থাৎ বিভিন্ন সময় বিজয় অভিযানে এদেশে প্রচুর বিদেশিরা এসেছে, 

একসময় তারা এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছে, বৈবাহিক সূত্রে হয়েছে। এভাবে একটি দ্বিমুখী ধারায় বাংলায় মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

২. মুসলিম সমাজের শ্রেণিবিন্যাস : 

সুলতানি আমলে বাংলার মুসলিম সমাজ কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। নিম্নে এগুলো আলোচনা করা হলো— 

ক. শাসক শ্রেণি : এ শ্রেণির মধ্যে ছিলেন সুলতান ও রাজপরিবারের সদস্যবৃন্দ। শাসক শ্রেণির জীবনাযাত্রা ছিল খুবই জাঁকজমকপূর্ণ এবং বিলাসিতায় টইটম্বুর। 

রাজপরিবারের সদস্যগণ সবসময় বিলাসিতায় আলো ঝলমলে জীবন যাপন করতো এবং অসংখ্য দাসদাসী দ্বারা বেষ্টিত থাকতো।

খ. অভিজাত ও উচ্চশ্রেণি : এ শ্রেণি মর্যাদাগতভাবে চারটি স্তরে বিভক্ত ছিল। প্রথম স্তরে ছিল নবাব, সুলতান, সৈয়দ, আলেম-ওলামা, পীর মাশায়েখ ও দরবেশ। সব শ্রেণির ওপর তাদের প্রভাব ও মর্যাদা ছিল। সর্বাধিক।

দ্বিতীয় স্তরে ছিল আমীর ওমারা, তাদের বশংবদ শ্রেণি। তৃতীয় স্তরে জমিদার, মুকাদ্দাম এবং চতুর্থ স্তরে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ । তবে অভিজাত সম্প্রদায় বংশগত ছিল না, এটি ছিল প্রতিভাগত ।

গ. মধ্যবিত্ত শ্রেণি : 

সুলতানি আমলে এখনকার মতো শিক্ষিত বুদ্ধিবৃত্তিমূলক প্রতিভা ও রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন মধ্যবিত্ত না থাকলেও বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিমূলক পেশায় নিয়োজিতরা এ শ্রেণিভুক্ত বলে পরিগণিত হতো। 

এদের মধ্যে ছিলেন জোতদার, নির্বাহী, হালদার, নিম্নপদস্থ কর্মচারী, কেরানি, চিকিৎসক, শিক্ষক, ধর্মপ্রচারক, কবি, সংগীত শিল্পী প্রমুখ। এঁরা সকলেই সচ্ছল জীবন যাপন করতেন।

সাধারণ শ্রেণি : কৃষক ও ক্ষুদ্র কারিগর, শ্রমিক বা খেটে খাওয়া যারা উৎপাদনের সাথে জড়িত, তাদের জীবনযাত্রা ছিল সাধারণ ও নিম্নমানের। 

মুসলমান সমাজে নিম্নস্তরের লোকেরা সাধারণত সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করতো অথবা সরকারের কেরানির চাকরি করা তারা পছন্দ করতো।

৩. সামাজিকতা : 

সুলতানি আমলে উভয় ধর্মীয় সমাজে ভিন্ন ভিন্ন সামাজিকতা পালিত হতো। মুসলিম সমাজে দু'ঈদ প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পালিত হতো। শবে-বরাত, জন্ম ও মৃত্যু দিবস, আকিকা, খাতনা, বিয়ে শাদি, আকবরী অনুষ্ঠান,

সুন্নিদের নববর্ষ এবং শিয়াদের মহররম উৎসব পালনসহ অন্যান্য উৎসব এ সময় পালন করা হতো। এসব উৎসবে উন্নত খাবার দাবারের আয়োজন করা হতো।

৪. খাদ্য ও পোশাক : 

খাদ্য হিসেবে মুসলিম সমাজে মাছ, মাংস, ভাত, শাকসবজি ইত্যাদি প্রচলিত ছিল। আর পোশাকের ক্ষেত্রে পুরুষরা পাঞ্জাবি, লুঙ্গি ও টুপি এবং নারীরা শাড়ি, ব্লাউজ ও বিভিন্ন প্রকার অলঙ্কার পরিধান করতো। তবে সর্বস্তরের মানুষের পোশাক পরিচ্ছদ প্রায় একই রকম ছিল।

৫. হিন্দু সামাজিকতা : 

বর্তমান সময়ের মতো সুলতানি আমলেও বাংলার হিন্দু সমাজ বর্ণাশ্রমের আবরণে মোড়া ছিল। হিন্দু সমাজ ছিল বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়। এ সময় জন্ম ও পেশার ওপর ভিত্তি করে হিন্দু সমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র- এ চার বর্ণে বিভক্ত ছিল। 

সুলতানি আমলে বাংলার শাসকরা এ সকল শ্রেণি ও নিরাপত্তার পাশাপাশি ধর্মীয় স্বাধীনতা লাভ করতো। ফলে হিন্দুরা জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার পাশাপাশি ধর্মীয় স্বাধীনতা লাভ করতো। 

হিন্দু সমাজে বর্তমানের মতো তৎকালেও বিভিন্ন পূজা পার্বণ পালা অনুষ্ঠানের রীতি প্রচলিত ছিল। হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। 

তাছাড়া সতীদাহ প্রথার মতো অমানবিক ন্যক্কারজনক প্রথা হিন্দু সমাজকে কলঙ্কিত করেছিল। জাতিভেদ প্রথা বিদ্যমান থাকায় স্বার্থান্বেষী ব্রাহ্মণ্যবাদের যাঁতাকলে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা নিষ্পেষিত ও নিপীড়িত হতো।

৬. হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক : 

সুলতানি আমলে বাংলার হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক কেমন ছিল এ বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারসহ কতিপয় সাম্প্রদায়িক ঐতিহাসিক বলেছেন, বাংলায় হিন্দু ও মুসলমান এ দু'সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক কখনোই ভালো ছিল না। 

কারণ দু'সম্প্রদায়ের আচার আচরণ থেকে শুরু করে খাওয়া দাওয়া, চাল চলন, জীবন যাপন সব কিছুই ছিল ভিন্ন। তারা বলেন, আর যাই হোক মধ্যযুগের হিন্দু মুসলিমদের সম্প্রীতি অটুট ছিল না। 

কিন্তু ভিনদেশি সংস্কারমুক্ত ঐতিহাসিক দল বিভিন্ন উপাত্তের সাহায্যে দেখানোর চেষ্টা করেছেন, মধ্যযুগে বাংলার হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে চমৎকার সদ্ভাব বিরাজিত ছিল। হিন্দু মুসলমান পরস্পর বিবাহ ও অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে সম্প্রীতির বন্ধনে যোগদান করতো।

৭. মুসলিম সমাজে হিন্দুধর্মের প্রভাব : 

সুলতানি বাংলার মুসলিম সমাজে হিন্দুধর্মের অনেক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। মুসলমানদের একটি বড় অংশ যেহেতু হিন্দু ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত ছিল সেহেতু তারা তাদের পূর্বের রীতিনীতি মজ্জাগতভাবে একেবার ভুলতে পারেনি। 

এ কারণে দেখা যায়, বিভিন্ন কুসংস্কার মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অনুপ্রবেশ ঘটে। আবার ইসলামের উদার দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাবে হিন্দুদের মধ্যে অনেক সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়।

৮. ক্রীতদাস প্রথা : 

ইবনে বতুতার বিবরণ থেকে সুলতানি আমলে বাংলায় দাসপ্রথা প্রচলিত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। সে সময় হাটে বাজারে দাস কেনাবেচা হতো। সমাজে ক্রীতদাস শ্রেণির অবস্থা সন্তোষজনক ছিল না। সুলতান, আমীর, মালিক প্রমুখ অভিজাতবর্গ ক্রীতদাস দাসী রাখতেন। 

দাসদাসী তাদের কাছে আভিজাত্যের চিহ্ন হিসেবে পরিগণিত হতো। সুলতানদের নিজস্ব হাজার হাজার ক্রীতদাস থাকতো। অবশ্য ক্রীতদাসদের মধ্যে অনেকেই স্বীয় প্রতিভা ও অধ্যবসায় বলে সমাজ ও রাষ্ট্রের উচ্চপদে আসীন হতে সক্ষম হয়েছিল।

তাহজীব তমদ্দুন ও নারীর অবস্থান : 

সুলতানি আমলে সমাজে হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ে প্রতিটি নারীরই উচ্চ মর্যাদা ছিল। অভিজাত মুসলমান এবং সামন্তশ্রেণির হিন্দু নারীদের মধ্যে পর্দা প্রথা বিদ্যমান থাকলেও তারা শৌখিন ও

আড়ম্বরপূর্ণ জীবন যাপনের জন্য শিক্ষাদীক্ষার চর্চা করতো। হিন্দু সমাজে সতীদাহ, বাল্যবিবাহ এবং জওহরব্রত প্রথা প্রচলিত ছিল। এতদসত্ত্বেও সমাজে তাহজীব তমদ্দুন তথা সংগীত ও নাচ গানের চর্চা বিদ্যমান ছিল।

সুলতানি আমলে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা:

সুলতানি আমলে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা জানার মতো পর্যাপ্ত উপকরণ পাওয়া যায়নি। তবে এ বিষয়ে মোটামুটি ধারণা লাভে বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ যথেষ্ট সাহায্য করে থাকে। নিম্নে সুলতানি আমলে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হলো

১. কৃষি কর্ম : 

বাংলা নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় এখানকার ভূমি বরাবরই উর্বর ছিল। ইবনে বতুতাসহ অন্যান্য বিদেশি পর্যটকরা বাংলার উর্বর মাটির কথা বলে গেছেন। চীনা পর্যটক মাহুয়ানের বিবরণ ক্ষেত্রে, সুলতানি আমলে বাংলার অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর। 

দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী ছিল কৃষিজীবী। তারা পরিশ্রম করে চাষ করে, রোপণ করে ও জমি উর্বর করে। সারাবছর পরিশ্রমের ফলে বাংলার আবাদি শস্য শ্যামলে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। 

বাঙ্গালি কৃষক নিজের পরিশ্রমেই নিজের স্বর্গ গড়ে তোলে। বছরে দুবার ফসল ফলাতো। ধানই ছিল এদেশের অন্যতম প্রধান ফসল। তাছাড়া আদা, মরিচ, পিঁয়াজ, শসা, বেগুন,

ইক্ষু, লবণ, চিনি, তুলা ও রেশম প্রভৃতি কৃষিপণ্য বাংলার স্থানীয় শিল্পের প্রয়োজন মিটাতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করছিল।" এগুলো দেশের চাহিদা মিটানোর পর বিদেশে রপ্তানি করা হতো।

২. শিল্প : 

সুলতানি আমলে বাংলার নগর বন্দরগুলো অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়। এ সময় অনেকে সমুদ্র বন্দর ও নদী বন্দরের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। 

ইবনে বতুতা চট্টগ্রাম বন্দরে অনেক বাণিজ্য জাহাজের আনাগোনা লক্ষ করেছিলেন বলে তাঁর বিবরণীতে উল্লেখ রয়েছে। এ সময় নৌ ও সমুদ্রপথে ব্যবসা বাণিজ্য হতো। কৃষি ও শিল্পজাত দ্রব্যে সমৃদ্ধ সাতগাঁও ছিল অন্যতম বৈদেশিক বাণিজ্য কেন্দ্র। 

বিদেশিরা বাংলার পণ্যের জন্যে সোনা, রূপা ও মুক্তার মাধ্যমে বাংলা থেকে ক্রয়কৃত দ্রব্যের দাম পরিশোধ করতো। ফলে সুলতানি আমলে মুদ্রা অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়। এ সময়ে রপ্তানি দ্রব্যের মধ্যে ছিল যথাক্রমে জাফরান, দস্তা, সিঁদুর, রৌপ্য, সুগন্ধি দ্রব্য, সুতিবস্ত্র, চাল, মূল্যবান পাথর ও নীল । 

৩. গ্রামীণ স্বাচ্ছন্দ্য : 

সুলতানি আমলে বাংলার গ্রামাঞ্চলে খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। তখন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির কোনো অভাবই ছিল না। প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর জন্য অন্যের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়নি। 

বস্ত্র, খাদ্যদ্রব্য, ছোট ছোট যন্ত্রপাতি প্রভৃতি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি নিজ নিজ গ্রামেই উৎপাদিত হতো।

৪. প্রাত্যহিক জীবনাযাত্রা : 

ইবনে বতুতা তাঁর বিবরণীতে বাংলা সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রথমেই এখানকার পর্যাপ্ত ধান চালের কথা বলেছেন। তিনি পৃথিবীর কোথাও এত সুলভ মূল্যে ধান চালের ক্রয় বিক্রয় হতে দেখেননি। 

তাঁর মতে, বাংলার হাটে বাজারে ১ রূপার দিনারে ২৫ রতল চাল পাওয়া যেতো। এক দিরহামে মোটাসোটা ৮টি মুরগি বা ১৫টি পায়রা পাওয়া যেত। একটি হৃষ্টপুষ্ট ভেড়ার দাম ছিল ২ দিরহাম। 

দাসের মূল্য ছিল এক থেকে দুসোনার দিনার। একখণ্ড অতি সূক্ষ্ম কার্পাস বস্ত্রের দাম ছিল ১ দিরহাম। মূল্য তালিকা সুলতানি আমলে বাংলায় উন্নত জীবনযাত্রার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। 

অবশ্য পর্যটক ইবনে বতুতা বলেছেন, দেশীয় লোকদের মতে, তখন জিনিসপত্রের দাম অত্যন্ত চড়া ছিল। আবার চীনা পরিব্রাজক মাহুয়ান বলেছেন, এ সময় বাঙ্গালিদের জীবনযাপন মান উন্নত ছিল ।

৫. সম্পদে ভরা জাহান্নাম : 

মরক্কোবাসী ইবনে বতুতা বাংলায় আগমন করেছিলেন বর্ষাকালে। তিনি সিলেট থেকে নদীপথে সোনারগাঁয়ে আসার সময় নদীর বাঁকে বাঁকে নগর বন্দর ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হন। 

নদীর তীরের কমলালেবুর বৃক্ষগুলো তাঁর মনে মিসরের নীলনদের তীরভূমির স্মৃতি জাগ্রত করেছিল। জীবনের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির প্রাচুর্য ও স্বল্পমূল্য এবং 

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাঁকে আকৃষ্ট করলেও বর্ষাকালের অতিবৃষ্টি, কর্দমাক্ত পথঘাট, বন্যা ও ম্যালেরিয়ার জীবাণু বহনকারী মশার উপদ্রব সহ্য করতে না পেরে তিনি বাংলা সম্পর্কে মন্তব্য করেন, 'দোযখপুর- আয নিয়ামত'। অর্থাৎ আশীর্বাদপুষ্ট জাহান্নাম বা ধন ভরা জাহান্নাম ।

৬. বৈষম্যপূর্ণ অর্থব্যবস্থা : 

সুলতানি আমলে এদেশ সমৃদ্ধিশালী থাকলেও সম্পদের বণ্টনে অসমতা ছিল। রাজন্যবর্গ এবং উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাগণই বেশি পরিমাণ সম্পদের অধিকর্তা ছিলেন। ফলে তাঁরা প্রাচুর্য ও

আড়ম্বরপূর্ণ বিলাসী জীবনযাপন করতেন। অপরদিকে, কৃষক, মজুর ও নিম্নশ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রার মান ছিল অনুন্নত। এ সম্পর্কে 'তারিখ-ই আলাই' গ্রন্থে ঐতিহাসিক আমীর খসরু বলেছেন, “রাজমুকুটের প্রতিটি মুক্তা যেন দরিদ্র কৃষকের রক্ত বিগলিত অশ্রুকণা।"

উপসংহার : 

উপরিউক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায়, সুলতানি আমলে বাংলার আর্থ-সামাজিক অঙ্গনে একটি স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছিল। এ সময়ে বাংলায় সম্পদের প্রাচুর্য ছিল, যা বিদেশিদের বিমোহিত করেছে। 

কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় তার পাশাপাশি বাণিজ্য প্রসারে অর্থনৈতিক অবস্থা একটি মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার বিভিন্ন উৎপাদিত দ্রব্য বিদেশিদের আকৃষ্ট করে। 

সুলতানি আমলেও বাংলার শিল্পোৎপাদনের ধারা অব্যাহত ছিল। সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় এর উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল।

নিত্য নতুন সকল আপডেটের জন্য জয়েন করুন

Telegram Group Join Now
Our Facebook Page Join Now
Class 8 Facebook Study Group Join Now
Class 7 Facebook Study Group Join Now
Class 6 Facebook Study Group Join Now

Post a Comment