বাংলায় ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনকাল

Follow Our Official Facebook Page For New Updates


Join our Telegram Channel!

প্ৰশ্ন : ৩২ ৷৷ বাংলায় ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনকালের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও । অথবা, বাংলায় ইলিয়াস শাহী বংশের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। অথবা, সংক্ষেপে ইলিয়াস শাহী রাজবংশের একটি বর্ণনা দাও।

ইলিয়াস শাহী বংশের





উপস্থাপনা : ১২০১ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজী সেন বংশের রাজা লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে বাংলায় সর্বপ্রথম মুসলিম শাসনের সূচনা করেন। ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে বাংলার শাসক আলাউদ্দিন শাহকে হত্যা করে সুলতান-ই-বাংলা ও শাহ-ই-বাংলা উপাধি গ্রহণ করে ইলিয়াস শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন। 

তিনি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ উপাধিতে ভূষিত হন। ফলে তাঁর নামানুসারে এ বংশের নাম হয় ইলিয়াস শাহী বংশ । 

বাংলায় ইলিয়াস শাহী রাজবংশ:

নিম্নে বাংলায় ইলিয়াস শাহী রাজবংশের ইতিহাস আলোচনা করা হলো 

১. শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ : 

শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে রাজ্যজয়ের প্রতি মনোনিবেশ করেন। তিনি প্রথমে ত্রিতে অভিযান করে জয় করেন। ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি নেপাল বিজয় করে প্রচুর ধন-সম্পদ হস্তগত করেন। 

তারপর তিনি পূর্ববাংলার রাজধানী সোনারগাঁ অধিকার করেন। এভাবে পরপর সাতগাঁও ও লখনৌতি দখল করেন। এর ফলে সমগ্র বাংলায় তিনি একচ্ছত্র সুলতানের মর্যাদা লাভ করেন। তাঁর 'শাহ-ই- বাংলা' উপাধিই এর সাক্ষ্য বহন করে। তারপর তিনি বিহার-ও উড়িষ্যা জয় করেন। 

১৩৫৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি কামরূপ অধিকার করেন। সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক বারবার অভিযান করেও আনুগত্য আদায়ে সক্ষম হননি।

২. সিকান্দার শাহ : 

১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দে সুলতান ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পর তাঁর সুযোগ্য পুত্র সিকান্দার শাহ বাংলার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি দীর্ঘ ৩৫ বছর বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। 

দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক পুনরায় বাংলা অধিকার করতে ব্যর্থ হন। ১৩৫৯ খ্রিস্টাব্দে ফিরোজ শাহ ও সিকান্দার শাহের মধ্যে এক সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়।

৩. গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ : 

সিকান্দার শাহের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ ১৩৯৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি ছিলেন দক্ষ, বিদ্যোৎসাহী এবং প্রজাবৎসল শাসক। সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের রাজত্বকালে শিক্ষা-দীক্ষা, সাহিত্য, শিল্পকলা, এমনকি ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয় ।

৪. সাইফউদ্দিন হামজা শাহ : 

গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সাইফউদ্দিন হামজা শাহ ১৪১০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনিও চীন সম্রাটের সাথে দূত বিনিময় করেন। তিনি প্রায় দুই বছর শাসনকার্য পরিচালনা করেন। সে সময় দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় ছিল।

৫. শিহাবউদ্দিন বায়েজিদ শাহ : 

শিহাবউদ্দিন বায়েজিদ শাহের প্রকৃত পরিচয় অনেক দিন পর্যন্ত অজ্ঞাত ছিল। বর্তমানে এ বিষয়ে যথেষ্ট ঐতিহাসিক তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে। বায়েজিদ শাহ কর্তৃক মুদ্রিত মুদ্রায় নিজেকে তিনি হামজা শাহের পুত্র বলে দাবি করেননি। 

ইবনে হজর তাঁর 'ইনবাউল গমর' গ্রন্থে বলেছেন, শিহাবউদ্দিন বায়েজিদ শাহ হামজা শাহের ক্রীতদাস ছিলেন এবং তিনি প্রভুকে হত্যা করে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। 

সম্ভবত রাজা হওয়ার পরে বায়েজিদ গণেশের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে সর্বময় কর্তৃত্ব লাভের চেষ্টা করেন, তাই গণেশ তাঁকে হত্যা করেন।

৬. আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ : 

কোনো ইতিহাস গ্রন্থে বায়েজিদ শাহের পরবর্তী সুলতানের নাম ও পরিচয় পাওয়া যায় না। কিন্তু বায়েজিদ শাহের শেষ বছরে অর্থাৎ ৮১৭ হিজরীতে আলাউদ্দিন ফিরোজ কর্তৃক উৎকীর্ণ মুদ্রা পাওয়া যায় এবং তাতে তনি নিজেকে বায়েজিদ শাহের পুত্ররূপে দাবি করেন। 

আধুনিক ঐতিহাসিকগণ বলেন, শিহাবউদ্দিনকে হত্যা করার পর গণেশ আলাউদ্দিনকে রাজা হিসেবে উপস্থাপন করে রাজ্য শাসন করতে থাকেন এবং কয়েক মাস পরে যখন আর কাউকে শিখণ্ডী হিসেবে না মানলেও শাসন ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হবে না বুঝতে পেরে, 

তিনি আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহকে হত্যা করে নিজেই সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। আলাউদ্দিনের রাজত্বকাল অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী ছিল। এভাবে রাজা গণেশের চক্রান্তে ইলিয়াস শাহী বংশের পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে।

৭. রাজা গণেশ ও তাঁর বংশধরগণ : 

গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের রাজত্বে হিন্দু অভিজাত সামন্তগণ বেশ প্রভাবশালী ছিলেন। এ সময় রাজা গণেশ নামে এক জমিদার ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সিংহাসন অধিকার করেন। ১৪১৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পুত্র যদু ইসলাম গ্রহণ করেন এবং জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন।

 জালালউদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শামসউদ্দিন সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু ১৪৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর পর গণেশের বংশের পতন ঘটে এবং ইলিয়াস শাহী বংশের পুনরুত্থান ঘটে।

৮. নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ : 

রাজা গণেশের বংশের পতনের পর ইলিয়াস শাহের পৌত্র নাসিরউদ্দিন ১৪৩৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সিংহাসনে বসেন। তিনি সুবিশাল রাজ্যের অধিকারী ছিলেন। তাঁর মুদ্রায় খলিফাতুল্লাহ বিল হুজ্জত ওয়াল বুরহান উপাধি উল্লেখ থাকতে দেখা যায়। 

তিনি জ্ঞানী, চরিত্রবান, ধর্মপরায়ণ ও প্রজাবৎসল শাসক ছিলেন। ঐতিহাসিকগণ তাঁর রাজত্বকালকে বাংলায় মুসলিম শাসনের একটি গৌরবময় অধ্যায় বলে অভিহিত করেছেন। ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন।

৯. রুকনউদ্দিন বরবক শাহ্ : 

নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রুকনউদ্দিন বরবক শাহ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি ছিলেন সাহসী যোদ্ধা, বিদ্বান, ন্যায়পরায়ণ ও শিল্পানুরাগী নরপতি। 

তাঁর আমলে মালাধর বসু 'শ্রীকৃষ্ণ বিজয়' রচনার সূচনা করেন। তাঁর সময়ে স্থাপত্যকলার বিশেষ উৎকর্ষ সাধিত হয়। দীর্ঘ ১৫ বছর রাজত্ব করার পর ১৪৭৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ।

১০. শামসউদ্দিন ইউসুফ শাহ : 

বরবক শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শামসউদ্দিন ইউসুফ শাহ ১৪৭৪ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি বিচক্ষণ, ধৈর্যশীল, প্রজাহিতৈষী ও ধর্মভীরু শাসক ছিলেন। ছোট পাণ্ডুয়ার মসজিদ তাঁর স্থাপত্য কীর্তির পরিচয় বহন করে। সাত বছর কৃতিত্বের সাথে রাজত্ব করে ১৪৮২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন।

১১. সিকান্দার শাহ : 

ইউসুফ শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সিকান্দার শাহ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু মস্তিষ্ক বিকৃতির জন্য অল্পদিন পরেই তাঁকে অপসারিত করে ইউসুফ শাহের অন্য পুত্র জালালউদ্দিন ফতেহ শাহকে সিংহাসনে বসানো হয়।

১২. জালালউদ্দিন ফতেহ শাহ : 

ইউসুফ শাহের মৃত্যুর পর তাঁর চাচা জালালউদ্দিন ফতেহ শাহ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু তার সময় হাবশিরা রাজ্যের শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে। কিন্তু তাদের দমন করতে গিয়ে তিনি তাদের হাতে নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে স্বাধীন ইলিয়াস শাহী বংশের পতন ঘটে। 

উপসংহার : 

অতএব বলা যায়, বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে ইলিয়াস শাহী বংশ একটি গৌরবোজ্জল অধ্যায়ের সূচনা করে। এ বংশ প্রায় একশ বারো বছর বাংলায় তাদের শাসন কর্তৃত্ব বহাল রাখে। 

তাদের আমলে বাংলায় সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ভাষা এক নতুনত্ব লাভ করে। নিঃসন্দেহে ইলিয়াস শাহী বংশের শাসকদের শাসনকাল বাংলার ইতিহাসে সমহিমায় ভাস্বর হয়ে থাকবে।


নিত্য নতুন সকল আপডেটের জন্য জয়েন করুন

Telegram Group Join Now
Our Facebook Page Join Now
Class 8 Facebook Study Group Join Now
Class 7 Facebook Study Group Join Now
Class 6 Facebook Study Group Join Now

Post a Comment