মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা
উপস্থাপনা :
খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের মধ্যভাগে আরব দেশের মুসলমানরা যখন একের পর এক দেশ জয় ও ধর্মবিস্তারে নিয়োজিত ছিলেন, সেই সময় উত্তর পশ্চিম ভারতে সম্রাট হর্ষবর্ধন এক বিশাল সাম্রাজ্যের ভিত্তি রচনা করেন।
কিন্তু ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর তার প্রতিষ্ঠিত বিশাল সাম্রাজ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হয়ে বহু স্বাধীন রাজ্যের উৎপত্তি হয়। এসব রাজ্যে সদা সর্বদা যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত। ফলে রাজ্যে অরাজকতা সৃষ্টি হয় ।
আরবদের সিন্ধু বিজয়/অভিযানের প্রাক্কালে ভারতের রাজনৈতিক অবস্থাঃ
ভারতীয় উপমহাদেশে আরবদের সিন্ধু বিজয়ের ইতিহাস মুসলমান এবং রাজপুত প্রধানদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রামেরই ইতিহাস। আরবদের সিন্ধু বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো
১. উত্তর ভারত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত :
আরবদের সিন্ধু বিজয়ের পূর্বে উত্তর ভারতে একক শক্তিশালী কোনো রাজ্য ছিল না। দশম শতকের শেষদিকে গুর্জর প্রতিহার বংশের অবসানের পর রাজপুত প্রধানগণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস ছিল মুসলমান এবং ক্ষুদ্র রাজপুত প্রধানদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রাম ও আন্দোলনের ফসল।
২. বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে সংঘাত ও যুদ্ধ :
আরবদের সিন্ধু বিজয়ের পূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে প্রায়ই দ্বন্দ্ব ও বিরোধ লেগেই থাকত এবং এক সময় তা ভয়াবহ যুদ্ধে রূপ নিত। এসব যুদ্ধে ব্যাপক হতাহতের ঘটনাও ঘটত।
এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক আবদুল আলীম বলেন, “তখন বিন্ধ্য পর্বতের উপরস্থ সমগ্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্যের খুবই অভাব ছিল এবং পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা বিরাজমান ছিল।”
৩. পশ্চিমাঞ্চল তিনটি রাজ্যে বিভক্ত :
আরবদের সিন্ধু বিজয়ের পূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চল তিনটি শক্তিশালী রাজ্যে বিভক্ত ছিল। যথা- (ক) উত্তর অঞ্চলের কাপিসি রাজ্য, (খ) দক্ষিণে সিন্ধু রাজ্য এবং (গ) এ দুই রাজ্যের মধ্যবর্তী তাজাকুট রাজ্য। এসব রাজ্যের শাসকগণ পরস্পরের সাথে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত ছিল।
৪. পূর্ব ভারতের সেন ও পাল রাজ্য :
আরবদের সিন্ধু বিজয়ের পূর্বে পূর্ব ভারতের সেন শাসকরা বাংলায় এবং পাল শাসকরা বিহারে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করছিলেন। বংশপরম্পরায় তাদের শাসনকাল দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। কিন্তু এ দীর্ঘস্থায়ী শাসন পরিচালনার এক পর্যায়ে তারা তাদের শৌর্য-বীর্য হারিয়ে ফেলে।
ফলে সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এ সুযোগে মুসলিম সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী লক্ষ্মণাবতী আক্রমণ করেন এবং বাংলায় মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন করেন।
৫. দাক্ষিণাত্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের সৃষ্টি :
আরবদের সিন্ধু বিজয়ের পূর্বে ভারতের দাক্ষিণাত্যে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অবসানের পর কতকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্যের সৃষ্টি হয়। এসব রাজ্যের মধ্যে দেবগিরির যাদব রাজ্য, তেলিঙ্গনার কাকতীয় রাজ্য, দ্বারসমুদ্রের হোয়সল রাজ্য এবং মাদুরার পাণ্ড্য রাজ্য সবিশেষ উল্লেখযোগ্য ।
৬. হিমালয় পার্বত্যাঞ্চল :
আরবদের সিন্ধু বিজয়ের পূর্বে হিমালয় পর্বতের পাদদেশে নেপাল, আফগান ও পাঞ্জাবসহ কতিপয় পার্বত্যাঞ্চল বিদ্যমান ছিল। ভারতে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনামলে আফগানিস্তানকে ভারতের একটি অংশ বলে চিহ্নিত করা হতো।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে নেপাল তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হলেও এটি একটি অবিভক্ত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে। গুপ্তযুগের পতনের পর নেপাল স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে।
৭. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা :
আরবদের সিন্ধু বিজয়ের পূর্বে ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। তখন রাজা হর্ষবর্ধন বিরাট সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেও তার মৃত্যুর পর রাজ্যের সর্বত্র যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় তা প্রায় ৫০ বছর স্থায়ী ছিল। এই বিশৃঙ্খলার সুযোগেই মুসলিম বিজেতাগণ রাজ্য জয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
৮. কেন্দ্রীয় শক্তির অভাব :
আরবদের সিন্ধু বিজয়ের পূর্বে ভারতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্যে কেন্দ্রীয় সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন শাসকের অভাবে রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করে। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে এসব রাজ্যের শাসকবৃন্দ দুর্বল হয়ে পড়েন। ফলে তারা মুসলমানদের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে।
৯. গোত্রীয় বিরোধ :
আরবদের সিন্ধু বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতীয় উপমহাদেশে গোত্রীয় বিরোধ ছিল অত্যন্ত প্রকট। জাতি, ধর্ম ও ভাষার দিক থেকে ভারতবর্ষ হচ্ছে বিশ্বের একটি বৈচিত্র্যময় এলাকা। বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে দীর্ঘদিন ঝগড়া বিবাদ লেগেই থাকত এবং এ বিরোধ নিরসনের কোনো চেষ্টা করা হতো না।
১০. স্বায়ত্তশাসন :
মুসলমানদের সিন্ধু বিজয়ের পূর্বে উত্তর ভারতের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলোতে স্বায়ত্তশাসন চালু ছিল। কনৌজ, আফগানিস্তান, সিন্ধু, কাশ্মীর, মালব, বুন্দেলখণ্ড, যোধপুর, নেপাল, আসাম প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। রাজ্যের প্রাদেশিক প্রধানকে বলা হতো উপারিকা' ।
প্রত্যেক প্রদেশ কতকগুলো জেলায় বিভক্ত ছিল। জেলাকে বলা হতো 'ভাষ'। আর জেলার শাসনকর্তাকে বলা হতো ‘ভাষপতি'।
১১. জনসাধারণের প্রতি অবজ্ঞা :
আরবদের সিন্ধু বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতে জনসাধারণের প্রতি ছিল রাজন্যবর্গের চরম অবহেলা। তারা জনসাধারণের কল্যাণের কোনো চেষ্টাই করতেন না। তাদের এরূপ অরজ্ঞার ফলে জনবিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়। তাই প্রয়োজনের সময় ভারতীয় শাসকরা জনসাধারণের সমর্থন এবং প্রত্যক্ষ সহযোগিতা লাভ করতে ব্যর্থ হয়।
১২. রাজনৈতিক, অনৈক্য :
এসময় ভারতীয় উপমহাদেশে চরম রাজনৈতিক অনৈক্য বিরাজমান ছিল। রাজনৈতিক বিবেচনায় তখন দেশে কোনো শক্তিশালী শাসনব্যবস্থা ছিল না। এরূপ সংকটাপন্ন অবস্থার সুযোগে অষ্টম শতকের প্রথমদিকে মুসলমানগণ ভারতবর্ষ আক্রমণ করে এ অঞ্চলে মুসলিম শাসনের গোঁড়া পত্তন করেন।
১৩. শাসকদের দুর্বলতা :
আরবদের সিন্ধু বিজয়ের পূর্বে রাজা অশোক, হর্ষবর্ধন, চন্দ্রগুপ্ত প্রমুখ ভারতীয় উপমহাদেশকে দুর্দান্ত প্রতাপের সাথে শাসন করেন। কিন্তু অষ্টম শতকের গোড়ার দিকে এ ধরনের শক্তিশালী শাসকের অভাব দেখা দেয়। এছাড়া তখনকার শাসকগণ দূরদর্শী ছিলেন না। শাসকদের এ দুর্বলতার সুযোগে আরবগণ ভারতবর্ষ আক্রমণে প্রলুব্ধ হয়।
১৪. শক্তিশালী রাজশক্তির অভাব :
যখন মুসলমানরা সিন্ধু আক্রমণ করে, তখন মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো কোনো শক্তি হিন্দু বা বৌদ্ধ রাজার ছিল না। ফলে শক্তিশালী মুসলিম বাহিনী অনায়াসে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে। আরবগণ এভাবে ভারতে ইসলামকে রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করে।
১৫. বিভিন্ন রাজবংশের উদ্ভব :
আরবদের সিন্ধু বিজয়ের পূর্বে ভারতবর্ষে বিভিন্ন রাজবংশের উদ্ভব ঘটে। এসব রাজবংশ পৃথক পৃথক মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিল। এছাড়া তাদের মধ্যে আত্মস্বার্থ চরিতার্থের স্পৃহা, হীনম্মন্যতা, ক্ষমতার মোহ, বিলাসিতা প্রভৃতির অনুপ্রবেশ ঘটে। এসব কারণে তখন মুসলিম শাসনের সূত্রপাত ঘটে।
১৬. আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের অভাব :
আরবদের সিন্ধু বিজয়ের পূর্বে হিন্দু রাজ্যগুলো সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকায় বহির্বিশ্বের সাথে সম্পর্কহীন হয়ে পড়ে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কোনো সম্প্রীতি ও সদ্ভাব ছিল না; বরং সামান্য বিষয় নিয়ে তারা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হতো। এ অবস্থাকে আরবগণ মোক্ষম সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে ভারতবর্ষে অভিযান পরিচালনা করে।
১৭. জাতীয়তাবোধের অভাব :
তৎকালে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের অভাব ছিল। এ সময় শাসকগোষ্ঠী নিজেদের ইচ্ছানুসারে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। তারা জনসাধারণকে জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রেও ছিলেন, উদাসীন। ফলে নিজ দেশ আরব কর্তৃক আক্রান্ত হলেও তারা এর স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখতে শাসকদের সহযোগিতা করেনি।
১৮. জনসাধারণের রাজনৈতিক অসচেতনতা :
মধ্যযুগীয় ভারতের জনসাধারণ রাজনৈতিক দিক দিয়ে অসচেতন ছিল। তারা রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্রীয় সমস্যার সমাধান দিতে ব্যর্থ হতো। রাজ্য শাসন অথবা সরকার গঠনের ব্যাপারে তাদের কোনো মাথাব্যথাই ছিল না ।
১৯. বৌদ্ধদের ওপর নির্যাতন :
তৎকালীন উত্তর ভারতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজমান ছিল বলে অনুমিত হয় না। মুসলমানদের ভারত আক্রমণের পূর্বে সিন্ধুর রাজা ছিলেন দাহির। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণ হিন্দু । তাই বৌদ্ধ ধর্মানুসারীরা নির্যাতিত হতো। এ কারণেই তারা তৎকালীন রাজা দাহিরের প্রতি বিরাগভাজন হয়ে উঠেন ।
উপসংহার :
আরবদের সিন্ধু বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। কেন্দ্রীয় শাসনের অভাব, রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত এবং বর্ণবৈষম্য তাদের ঐক্য ও শক্তিকে চরমভাবে ধ্বংস করে।
ভারতীয় শাসকদের অনৈক্যের কারণেই মুসলমানদের আক্রমণ প্রতিরোধ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। মুসলমানগণ এ সুযোগে ভারতে রাজ্য কায়েম করতে সক্ষম হন ।
নিত্য নতুন সকল আপডেটের জন্য জয়েন করুন
If any objections to our content, please email us directly: helptrick24bd@gmail.com