সুলতানি আমলে বাংলার স্থাপত্যসমূহ

Follow Our Official Facebook Page For New Updates


Join our Telegram Channel!

প্ৰশ্ন : সুলতানি আমলে বাংলার স্থাপত্য কলার বিবরণ দাও । অথবা, মধ্যযুগের বাংলার স্থাপত্যশিল্প সম্পর্কে যা জান লেখ। অথবা, সুলতানি আমলে বাংলার স্থাপত্য অবকাঠামোর বর্ণনা দাও। অথবা, দিল্লির সুলতানগণ বাংলায় কী কী স্থাপত্যকীর্তি রেখে যান তা আলোচনা কর।

বাংলার স্থাপত্য




মধ্যযুগে বাংলার স্থাপত্য কলার নিদর্শন পাওয়া যায় মুসলমান সুলতানদের নির্মিত মসজিদ, সমাধি সৌধ ও বিভিন্ন ভবনে। মুসলমান শাসকগণ ইসলামের গৌরবকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে এবং নিজেদের রাজ্যজয় ও শাসনামলকে স্মরণীয় করে রাখতে বঙ্গের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে অনেক সমাধিসৌধ, মসজিদ, দুর্গ, প্রাসাদ, দরগাহ ইত্যাদি নির্মাণ করেছিলেন। 

সুলতানি যুগের নির্মিত এসব স্থাপত্যশিল্পের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এখনো অনেক মূল্যবান তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়। 

সুলতানি আমলে বাংলার স্থাপত্য কলা: 

সুলতানি আমলে বাংলার স্থাপত্য কলা ছিল অসাধারণ। নিম্নে এসব স্থাপত্য কলা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

১. আদিনা মসজিদ : 

সুলতানি আমলের স্থাপত্যকীর্তির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হলো পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদ। ১৩৪৬-৭৪ খ্রিস্টাব্দে সুলতান সিকান্দার শাহ 'আদিনা মসজিদ' নির্মাণ করেন। এটি বাংলার বৃহত্তম মসজিদ । ‘রিয়াজুস সালাতীন'-এর বর্ণনা অনুসারে, সিকান্দার শাহ এ মসজিদের নির্মাণ কাজ শেষ করে যেতে পারেননি। 

ইতিহাসবেত্তা সুখময় মুখোপাধ্যায়ের মতে, সিকান্দার শাহের জীবদ্দশাতেই এ মসজিদের নির্মাণ কাজ সুসম্পন্ন হয়েছিল। কারণ এ শিলালিপির উৎকলিত তারিখের পরেও সিকান্দার শাহ আরো একুশ বছর জীবিত ছিলেন। আদিনা মসজিদের পশ্চিম দিকের বহির্দেয়ালে যে শিলালিপি রয়েছে তা থেকে জানা যায়, সিকান্দার শাহ এ মসিজদের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেছিলেন। 

পাওয়া থেকে এক মাইল উত্তরে এ মসজিদটি অবস্থিত। এর দৈর্ঘ্য ৫০৭ ফুট, গ্রস্থ ২৮৫ ফুট। প্রায় দশ হাজার মুসল্লি একসাথে এখানে নামায আদায় করতে পারতো। এ মসজিদের ৩৭৮টি গম্বুজ রয়েছে, সুলতান সিকান্দার শাহ এ মসজিদে নিয়মিত নামায আদায় করতেন।

২. গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের সমাধি : 

গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের সমাধি সুলতানি স্থাপত্যকলার একটি অপূর্ব নিদর্শন। বর্তমান ঢাকা থেকে ১৬ মাইল দূরে সোনারগাঁয়ে গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের সমাধি সৌধ অবস্থিত। 

এটি ১৪১০ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়। এ সমাধি সৌধের অতি নিকটে পাঁচটি দরগাহ ও একটি মসজিদ অবস্থিত। এগুলো 'পাঁচ পীরের দরগাহ' নামে পরিচিত।

৩. বড় সোনা মসজিদ : 

বড় সোনা মসজিদ সুলতানি যুগের স্থাপত্যকীর্তির একটি শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। আসাম বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ‘বড় সোনা মসজিদ' নির্মাণ করেছিলেন। এর অপর নাম বারদুয়ারি মসজিদ'। এতে বৃহৎ বারোটি দরজা ছিল। 

এ মসজিদে সোনালি রঙের গিলটি করা কারুকার্য ছিল বলে সম্ভবত এটি সোনা মসজিদ নামে অভিহিত হতো। ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে নসরত শাহ এর নির্মাণকার্য শেষ করেন। এ মসজিদ নির্মাণে কারিগররা দিল্লির লোদী স্থাপত্যরীতির অনুসরণ করেছিলেন। 

এ মসজিদের নির্মাণ কাজে ইট ও পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। পাথরগুলোর উপরিভাগ অলঙ্কারিক কারুকার্য খচিত ছিল।

৪. ছোট সোনা মসজিদ :

সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলের জনৈক ওয়ালি মুহাম্মদ ‘ছোট সোনা মসজিদ' নির্মাণ করেন। গৌড় শহরে সর্বশেষ দক্ষিণ প্রান্তে বর্তমান চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার ফিরোজাবাদ গ্রামে ছোট সোনা মসজিদ অবস্থিত। 

সোনালি রঙের গিলটির কারণে এ মসজিদটি ‘ছোট সোনা মসজিদ' হিসেবে পরিচিত। কারুকার্য ও স্থাপত্যকলার উৎকর্ষতার জন্য এ মসজিদটি বিশেষভাবে প্রসিদ্ধি অর্জন করে।

৫. নত্তন মসজিদ : 

সুলতান ইউসুফ শাহের আমলে ১৪৭৫ খ্রিস্টাব্দে পোড়ামাটির ইট ও পাথর দ্বারা এ মসজিদটি নির্মিত হয়। মসজিদটি গৌড় শহরের দক্ষিণ অংশে অবস্থিত। রাজার প্রিয় নর্তকী নত্তন বিবি কর্তৃক এ মসজিদটি নির্মিত হয়েছে বলে প্রবাদ রয়েছে। 

গঠন নৈপুণ্যে ও শিল্প সৌকর্যে এটি একটি প্রসিদ্ধ মসজিদ। মসজিদের অভ্যন্তর ভাগ ৩৪ বর্গ ফুট এবং বহির্দেশ ৭২ ফুট দীর্ঘ ও ৫১ ফুট প্রশস্ত। এর পূর্বদিকে খিলানযুক্ত তিনটি প্রবেশ পথ রয়েছে। 

মসজিদ গাত্রের বহির্দিকের ইটগুলো কারুকার্য দ্বারা শোভিত। মেজর ফ্রাঙ্কলিনের মতে, নত্তন মসজিদের কারুশৈলী অতুলনীয়।

৬. ষাট গম্বুজ মসজিদ:

পনেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে ষাট গম্বুজ মসজিদটি নির্মিত হয়। খানজাহান আলীর সমাধির তিন মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে ষাটগম্বুজ মসিজদটি অবস্থিত। এজন্য অনেক ঐতিহাসিকের মতে, খানজাহান আলী এটি নির্মাণ করেন। 

এটি বাংলার অন্যতম বৃহৎ মসজিদ। অপূর্ব গঠনশৈলীর জন্য বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ বঙ্গ মুসলিম শাসনামলের গৌরব বৃদ্ধি করছে। এ মসজিদের ষাট গম্বুজ নামকরণ করা হলেও এর গম্বুজের সংখ্যা ৮১টি। 

এ মসজিদেও আগুনে পোড়ানো লাল রঙের ইট ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলার প্রতিকূল আবহাওয়ার প্রতি লক্ষ রেখে এ মসজিদের কার্নিস ঈষৎ বাঁকা করে নির্মাণ করা হয়েছে।

৭. গৌড়ের চিকা মসজিদ : 

সুলতানি যুগে নির্মিত গৌড়ের মসজিদ একলাখী মসজিদের অনুরূপ হলেও আয়তনে বেশ ছোট। এর মধ্যে বেদী নেই বললেই চলে। কেউ কেউ ধারণা করেন এটি সুলতান মাহমুদের সমাধি সৌধ। মূলত এর মধ্যে কোনো কবর বা মাজার আদৌ নেই। 

আবার অনেকের মতে, এটি সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের নির্মিত একটি বিশেষ তোরণ। অবশ্য এর গঠনপ্রণালি অনেক পুরাতন বলে মনে হয় ।

৮. বাবা আদমের মসজিদ : 

সুলতানি আমলের একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য নিদর্শন হলো বাবা আদমের মসজিদ। মালিক কাফুর ফতেহ শাহের রাজত্বকালে ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে এটি নির্মিত হয়েছিল। ঢাকা জেলার রামপালে 'বাবা আদমের মসজিদ অবস্থিত। 

এটি হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ওপর নির্মিত। এর শিল্পকার্যের সাথে মাহমুদ শাহী আমলে নির্মিত গৌড়ের মসজিদগুলোর সাদৃশ্য রয়েছে।

৯. একলাখী মসজিদ : 

সুলতানি শাসনামলের একটি উৎকৃষ্ট স্থাপত্য নিদর্শন হলো পাণ্ডুয়ার একলাখী মসজিদ। এ মসজিদের স্থাপত্যকলায় হিন্দু স্থাপত্যরীতির প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। অনেকে মনে করেন যে, রাজা গণেশ লক্ষ্মী দেবীর উপাসনার জন্য যে মন্দির নির্মাণ করেছিলেন তাঁর পুত্র জালালউদ্দিন একে একলাখী মসজিদে রূপান্তরিত করেন। 

প্রবাদ আছে, তখনকার দিনে এটি ছিল দৈর্ঘ্যে ৭৮ ও প্রস্থে ৭৪ ফুট। কিন্তু ভিতরে এটি অষ্টকোণাকৃতি এবং এর ওপর অর্ধবৃত্তাকার গম্বুজ রয়েছে। চতুর্দিকে একটি করে খিলানযুক্ত তোরণ রয়েছে। এতে হিন্দু স্থাপত্যের নিদর্শনযুক্ত বহু প্রস্তরখণ্ড দেখা যায়। ভবনটির কার্নিস বাংলা কুঁড়েঘরের চালের মতো ঈষৎ বাঁকানো এবং দেয়াল অনেক বাড়ানো ।

১০. খানজাহান আলীর সমাধি সৌধ : 

বর্তমান বাগেরহাট জেলায় খানজাহান আলীর সমাধিটি অবস্থিত। এ সমাধির স্থাপত্যকলায় দিল্লির তুঘলক আমলের শিল্পকলার প্রভাব লক্ষ করা যায়। কিংবদন্তী অনুসারে খানজাহান আলী নামক জনৈক পীর সে স্থানে বসতি স্থাপন করেন এবং এখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। 

সমাধির শিলালিপির তারিখ (৪৫৯ খ্রিস্টাব্দ) অনুযায়ী খানজাহান আলী পরবর্তী ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের সমসাময়িক ছিলেন।

১১. কদম রসূল ভবন : 

অধিকাংশ পণ্ডিতের ধারণা গৌড়ের বিখ্যাত ‘কদম রসূল’ ভবনটি সুলতান নসরত শাহ নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি শামসউদ্দিন ইউসুফ শাহের আমলে নির্মিত। 

নসরত শাহ শুধু এ প্রাসাদ প্রাকোষ্ঠের একটি মঞ্চ নির্মাণে সহযোগিতা করেন এবং তাঁর ওপর মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর পদচিহ্ন সংবলিত একটি কালো কারুকার্য খচিত মর্মর বেদী বসান। এ প্রকোষ্ঠের দরজার মাথায় একটি শিলালিপিতে লেখা রয়েছে, 

“সুলতান নাসিরউদ্দিন নসরত শাহ ৯৩৬ হিজরিতে এ পবিত্র মঞ্চ এবং উপস্থাপিত পাথর, যার উপরে রাসূল (স)-এর পদচিহ্ন রয়েছে, তা উৎকীর্ণ করেছিলেন এবং একটি সুলতানি আমলে স্থাপত্যশিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শন।”

১২. তোরণ কক্ষ ও মিনার : 

মসজিদ ও সমাধি সৌধ ছাড়াও সুলতানি যুগের নির্মিত বিভিন্ন তোরণ কক্ষ ও মিনার মুসলিম বাংলার স্থাপত্যশিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। এগুলো হলো:

ক. ফিরোজ মিনার : গৌড়ের ফিরোজ মিনার সুলতানি স্থাপত্যশিল্পের একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন। অনেকে মনে করেন, হাবশি সুলতান সাইফউদ্দিন ফিরোজ শাহ এটি নির্মাণ করেছিলেন। মিনারটি পাঁচতলায় বিভক্ত এবং ৮৪ ফুট উঁচু। 

এর সর্বনিম্নের অংশের পরিধি ৬২ ফুট। নিচের তিনটি তলা দ্বাদশ টালি কোণ সমন্বিত এবং উপরের দু'তলা গোলাকৃতি। ইটের তৈরি এ মিনারের উপরিভাগ পোড়ামাটির নানা নকশা এবং নীল ও সাদা রঙের মসৃণ দ্বারা শোভিত ।

খ. দাখিল দরোজা : গৌড়ের দাখিল দরোজা ও আলাউদ্দিন হোসেন শাহের সমাধি তোরণ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। দাখিল দরোজা ইট দ্বারা নির্মিত এবং ৬০ ফুট উঁচু ও ৭৩ ফুট প্রশস্ত । কারুকার্য শোভিত সম্মুখভাগের মধ্যস্থলে ৩৪ ফুট উঁচু খিলানযুক্ত বিশাল তোরণ রয়েছে। 

এর দুপাশে দুটি বিশাল স্তম্ভ এবং তার সাথে সংযুক্ত দ্বাদশ কোণ সমন্বিত দুটি অট্টালিকা ক্রমশ সরু হয়ে উপরে উঠেছে। প্রতিটি অট্টালিকা পাঁচটি তলায় বিভক্ত। সম্মুখভাগের ঠিক মধ্যস্থলে অবস্থিত তোরণের প্রবেশদ্বার থেকে অভ্যন্তরে প্রবেশ পথ ১১৩ ফুট লম্বা এবং ১৪ ফুট উঁচু খিলান আবৃত। এর দু'ধারে রক্ষীদের কক্ষ।

শেষ কথা : 

উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, সুলতানি আমলে বাংলায় মুসলিম স্থাপত্য কলার যথেষ্ট উৎকর্ষ সাধিত হয়। সুলতানদের পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগেও এ সময় স্থাপত্যশিল্পের বিকাশ ঘটে। 

গৌড় ও বাংলার বিভিন্ন স্থানে সুলতানি শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় যেসব মসজিদ ও সমাধি রয়েছে তা সে যুগের উৎকৃষ্ট কলার অনন্য নিদর্শন। স্থাপত্যশিল্পে অপরিসীম অবদানের জন্য সুলতানি আমলের শাসকগণ বাংলার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন যুগযুগ ধরে।

নিত্য নতুন সকল আপডেটের জন্য জয়েন করুন

Telegram Group Join Now
Our Facebook Page Join Now
Class 8 Facebook Study Group Join Now
Class 7 Facebook Study Group Join Now
Class 6 Facebook Study Group Join Now

Post a Comment