প্রশ্ন ৷৷ বাংলায় তুর্কি শাসন প্রতিষ্ঠার ইতিহাস সংক্ষেপে আলোচনা কর। অথবা, বাংলায় তুর্কি শাসনের ইতিহাস আলোচনা কর।
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার সূচনা করেন। বাংলায় মুসলিম শাসনের প্রথম শাসনকর্তাদের কেউ ছিলেন বখতিয়ারের সহযোদ্ধা খলজী মালিক এবং কেউ ছিলেন তুর্কি বংশের শাসক। পরবর্তীতে বাংলা দিল্লির শাসনাধীন একটি প্রদেশে পরিণত হয়।
এই ষাট বছর বাংলার অধিকাংশ শাসকই ছিলেন 'দাস' বা 'মামলুক' বংশের। তবে তারা সকলেই ছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভূত। এ সকল শাসকদের সকলেই দিল্লির সুলতানের অধীন ছিলেন এবং এদের মধ্যে অনেকেই দিল্লির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে স্বাধীন হতে চেষ্টা করেও সফল হননি।
বাংলায় তুর্কি শাসন প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
১২২৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান ইলতুৎমিশের জ্যেষ্ঠ পুত্র নাসিরউদ্দিন মাহমুদ সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওয়াজ খলজীকে পরাজিত ও নিহত করে বাংলা অধিকার করেন। এরপর থেকে ১২৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মোট পনেরো জন তুর্কি শাসনকর্তা বাংলা
শাসন করেন। সেজন্য এ সময়কালকে তুর্কি যুগ বলা হয়। বাংলায় তুর্কি শাসনের সময় দিল্লিতে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ চলছিল। ফলে বাংলার মতো দূরবর্তী প্রদেশের শাসনকার্যের দিকে সুলতানদের মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ ছিল না।
এতে বাংলার তুর্কি শাসকগণ দিল্লির অধীন হয়েও অনেকটা স্বাধীনভাবে দেশ পরিচালনা করতেন। নিম্নে বাংলার উল্লেখযোগ্য কয়েকজন তুর্কি শাসকের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস বর্ণনা করা হলো:
১. নাসিরউদ্দিন মাহমুদ :
১২২৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওয়াজের পরাজয় ও মৃত্যুর পর বাংলা দিল্লির অধীনে চলে যায় এবং যুবরাজ নাসিরউদ্দিন মাহমুদ দিল্লির শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। তিনি ছিলেন দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিশের পুত্র।
এর পূর্বে নাসিরউদ্দিনকে অযোধ্যায় শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়েছিল। ফলে তিনি অযোধ্যা থেকে লখনৌতি পর্যন্ত এলাকার শাসনকর্তা ছিলেন। তিনি লখনৌতিতে বাংলার রাজধানী স্থানান্তর করেন। কিন্তু ১২২৯ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে তিনি ইন্তেকাল করেন।
২. দওলত শাহ ও বলকা খলজী :
নাসিরউদ্দিনের আকস্মিক মৃত্যুর পর লখনৌতিতে গোলযোগ সৃষ্টি হয়। এ সময় নাসিরউদ্দিনের সেনাধ্যক্ষ দওলত শাহ নতুন শাসনকর্তা নিযুক্তির পূর্ব পর্যন্ত শাসনকার্য পরিচালনা করেন এবং ইলতুৎমিশের আনুগত্য স্বীকার করে মুদ্রার প্রবর্তন করেন।
সম্ভবত এ সময় উচ্চাকাঙ্ক্ষী সৈনিক বলকা খলজী দওলত শাহ কর্তৃক ক্ষমতা দখলকে অগ্রাহ্য করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং ইলতুৎমিশ তাকে পরাজিত করার উদ্দেশ্যেই বাংলা অভিযান করেছিলেন।
৩. মালিক আলাউদ্দিন জানি :
দওলত শাহ ও বলকা খলজী উভয়েরই শাসন স্বল্পকালীন ছিল। ইলতুৎমিশ মালিক আলাউদ্দিন জানিকে পরবর্তী শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। মালিক আলাউদ্দিন জানি তুর্কিস্তানের শাহজাদা ছিলেন। তিনি এক বছরেরও কিছু বেশি সময় লখনৌতির শাসনকর্তা ছিলেন।
৪. আওর খান আইবেক :
১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে ইলতুৎমিশের মৃত্যুর পর প্রথমে সাইফউদ্দিন আইবেক বাংলার শাসন ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু অল্পকালের মধ্যে তাঁর মৃত্যু হলে আওর খান আইবেক লখনৌতির ক্ষমতা অধিকার করেন। তবে কিছুদিন পরেই বিহারের শাসনকর্তা তুলি তুঘান খানের হাতে পরাজিত হন।
৫. তুঘিল তুঘান খান :
১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে আওর খানকে পরাজিত করে তুঘান খান বাংলার শাসন ক্ষমতা দখল করেন। তিনি ১২৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৯ বছর বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন। এরপর মাত্র দুই বছর ওমর খান লখনৌতির শাসন ক্ষমতায় ছিলেন।
৬. জালালউদ্দিন মাসুদ জানি :
১২৪৭-১২৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ওমর খানের পর জালালউদ্দিন মাসুদ জানি বাংলা শাসন করেন। তিনি লখনৌতিতে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। তিনি ১২৫৫ খ্রিস্টাব্দে 'মুগিসউদ্দিন' উপাধি ধারণ করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। অতঃপর ১২৫৭ খ্রিস্টাব্দে কামরূপ আক্রমণ করতে গিয়ে শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও নিহত হন।
৭. মালিক ইচ্ছুদ্দিন উজবেক :
জালালউদ্দিন মাসুদ জানির পর দুই বছর মালিক ইজ্জুদ্দিন উজবেক লখনৌতি স্বাধীনভাবে শাসন করেন। পরে ১২৫৯ খ্রিস্টাব্দে কারা প্রদেশের শাসনকর্তা তাজউদ্দিন আরসালান খান লখনৌতির সিংহাসনে আরোহণ করেন।
৮. তাতার খান :
আরসালান খানের পর তাতার খান বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। তাতার খান দিল্লির সুলতান বলবনের আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু অল্পদিন পর তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর বংশের শের খান প্রায় চার বছর লখনৌতি শাসন করেন এবং তিনি গিয়াসউদ্দিন বলবনের নামেই মুদ্রা চালু করেন।
৯. তুঘিল খান :
বাংলার পরবর্তী শাসকদের মধ্যে মুগিসউদ্দিন তুম্রিল খান ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁর সময়ে বাংলায় মুসলিম শাসন বিস্তৃত হয়। উত্তর ও পশ্চিম বাংলা ছাড়া ঢাকা ও ফরিদপুরের বেশকিছু অঞ্চল তিনি স্বীয় অধিকারে আনতে সক্ষম হন।
ঢাকার অদূরে সোনারগাঁয়ের নিকট 'নারাকিল্লা' নামে তিনি একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। তুঘ্রিল 'মুগিসউদ্দিন' উপাধি নিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এতে দিল্লির সুলতান বলবন তাঁর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ করেন। ১২৮১ খ্রিস্টাব্দে তুলি বলবনের হাতে পরাজিত ও নিহত হন।
১০. বুঘরা খান :
তুঘ্রিলের বিদ্রোহ দমন করার পর গিয়াসউদ্দিন বলবন নিজ পুত্র বুঘরা খানকে বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। ইতঃপূর্বে তিনি সামান প্রদেশের শাসনকর্তা ছিলেন।
১২৮৭ খ্রিস্টাব্দে বলবনের মৃত্যুর পর বুঘরা খান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ নাম নিয়ে স্বাধীন সুলতান হিসেবে বাংলা ... শাসন করতে থাকেন। এ সময় বুঘরা খানের ছেলে কায়কোবাদ দিল্লির সুলতান ছিলেন।
১১. রুকনউদ্দিন কায়কাউস :
দিল্লির সুলতান কায়কোবাদ অকর্মণ্য এবং অলস ছিলেন। তাঁকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য বুঘরা খান দিল্লি প্রত্যাবর্তন করেন এবং অপর পুত্র রুকনউদ্দিন কায়কাউসকে বাংলার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেন।
কায়কাউস দশ বছর বাংলার শাসক ছিলেন। তাঁর কোনো উত্তরাধিকারী না থাকায় মালিক ফিরোজ ইতগীন পরবর্তী শাসনকর্তা নিযুক্ত হন।
১২. গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ :
মালিক ফিরোজ ইতগীন শাসন ক্ষমতায় আরোহণের পর 'সুলতান শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহ' উপাধি ধারণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ বাংলার সিংহাসনে সমাসীন হন। অল্পকাল পরেই দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের হাতে তিনি পরাজিত ও বন্দি হন।
১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে মুক্তি দিয়ে সোনারগাঁয়ে প্রেরণ করা হয়। সেখানে তিনি বাহরাম খানের সাথে যুগ্মভাবে শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি পুনরায় বিদ্রোহ করলে বাহরাম খানের হাতে নিহত হন। এরপর ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা দিল্লির অধীনে শাসিত হয় ।
উপসংহার :
বহুদিন যাবৎ বলবৎ থাকলেও বাংলায় তুর্কি শাসনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই বহিরাক্রমণের ফলে বাংলায় তুর্কি শাসনের ভিত বারবার কেঁপে উঠেছিল। অর্থাৎ বাংলায় তুর্কি শাসনের যুগ ছিল বিদ্রোহ বিশৃঙ্খলা পরিপূর্ণ । তুর্কি শাসকগণ দিল্লির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সফল হয়নি। তবে দিল্লি আক্রমণের ফলেও তারা বহু বছর বাংলা শাসন করেছে।
নিত্য নতুন সকল আপডেটের জন্য জয়েন করুন
If any objections to our content, please email us directly: helptrick24bd@gmail.com