আরবদের সিন্ধু বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতের অবস্থাসমূহ

Follow Our Official Facebook Page For New Updates


Join our Telegram Channel!

ইসলামের ইতিহাসঃ 

আরবদের সিন্ধু বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা 

আরবদের সিন্ধু বিজয়ের প্রাক্কালে






আরবদের সিন্ধু অভিযানের প্রাক্কালে উত্তর ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা:

উপস্থাপনা : 

আরবদের সিন্ধু বিজয়ের পূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশ কতকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল এবং এ রাজ্যগুলোর মধ্যে ঐক্য ও সংহতির অভাব ছিল না। 

এসব রাজ্যের মধ্যে সর্বদা দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত। এছাড়া জাতিভেদ প্রথা ও সংকীর্ণতা তাদের সমাজজীবনের জন্য ধ্বংস ডেকে আনে । আরবদের সিন্ধু বিজয়ের/অভিযানের প্রাক্কালে ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা ভারতীয় উপমহাদেশে আরবদের সিন্ধু বিজয়ের ইতিহাস মুসলমান এবং রাজপুত প্রধানদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রামেরই ইতিহাস। 

আরবদের সিন্ধু বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা কেমন ছিল সে সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো

আরবদের সিন্ধু বিজয়ের প্রাক্কালে রাজনৈতিক অবস্থা:

১. ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের উদ্ভব : 

আরবদের সিন্ধু বিজয়ের পূর্বে উত্তর ভারতে একক শক্তিশালী কোনো রাজ্য ছিল না। দশম শতকের শেষদিকে গুর্জর প্রতিহার বংশের অবসানের পর রাজপুত প্রধানগণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস ছিল মুসলমান এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজপুত প্রধানদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রামের ফসল।

২. রাজনৈতিক অনৈক্য : 

আরবদের সিন্ধু বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতীয় উপমহাদেশে চরম রাজনৈতিক অনৈক্য বিরাজমান ছিল। রাজনৈতিক বিবেচনায় সে সময় দেশে কোনো শক্তিশালী শাসনব্যবস্থা ছিল না। এরূপ সংকটাপন্ন অবস্থার সুযোগে অষ্টম শতকের প্রথমদিকে মুসলমানগণ ভারতবর্ষ আক্রমণ করে এ অঞ্চলে মুসলিম শাসনের সূচনা করেন ।

৩. পশ্চিমাঞ্চল তিনটি রাজ্যে বিভক্ত : 

আরবদের সিন্ধু বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চল তিনটি শক্তিশালী রাজ্যে বিভক্ত ছিল । যথা- (ক) উত্তর অঞ্চলের কাপিসি রাজ্য, (খ) দক্ষিণে সিন্ধু রাজ্য এবং (গ) এ দুই রাজ্যের মধ্যবর্তী তাজাকুট রাজ্য। এসব রাজ্যের শাসকগণ পরস্পরের সাথে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত ছিল ।

৪. পূর্ব ভারতের সেন ও পাল রাজ্য : 

তৎকালীন পূর্ব ভারতের সেন শাসকগণ বাংলায় এবং পাল শাসকগণ বিহারে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করছিলেন। তাদের শাসনকাল বংশপরম্পরায় দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। কিন্তু এ দীর্ঘস্থায়ী শাসন পরিচালনার এক পর্যায়ে তারা তাদের শৌর্য-বীর্য হারাতে থাকলে সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি দেখা দেয়। 

এ সুযোগে মুসলিম সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে বখতিয়ার খিলজী লক্ষ্মণাবতী আক্রমণ করে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূত্রপাত করেন।

৫. দাক্ষিণাত্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের উদ্ভব : 

আরবদের সিন্ধু অভিযানের প্রাক্কালে ভারতের দাক্ষিণাত্যে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর কতকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব হয়। এসব রাজ্যের মধ্যে দেবগিরির যাদব রাজ্য, তেলিঙ্গনার কাকতীয় রাজ্য, দ্বারসমুদ্রের হোয়সল রাজ্য এবং মাদুরার পাণ্ড্য রাজ্য বিশেষভাবে পরিচিত।

৬. রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা : 

আরবদের সিন্ধু বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। তখন রাজা হর্ষবর্ধন বিরাট সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেও তার মৃত্যুর পর রাজ্যের সর্বত্র যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় তা প্রায় ৫০ বছর চলছিল। উত্তর ভারতের রাজনৈতিক এই বিশৃঙ্খলার সুযোগেই মুসলিম বিজেতাগণ রাজ্য জয়ে আগ্রহী হন। 

৭. রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা : 

আরবদের সিন্ধু বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্যে কেন্দ্রীয় সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন শাসক না থাকায় রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা ও কলহ-বিবাদ তীব্র হয়ে ওঠে। এসব রাজ্যের শাসকবৃন্দ অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। ফলে তারা মুসলমানদের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হন।

৮. গোত্রীয় বিরোধ : 

আরবদের সিন্ধু অভিযানের পূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশে গোত্রীয় বিরোধ ছিল অত্যন্ত প্রকট। বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে দীর্ঘদিন ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকত এবং এ বিরোধ নিরসনের কোনো চেষ্টা করা হতো না। কারণ জাতি, ধর্ম ও ভাষার দিক থেকে ভারতবর্ষ ছিল বিশ্বের একটি বৈচিত্র্যময় অঞ্চল ।

৯. স্বায়ত্তশাসন : 

আরবদের সিন্ধু বিজয়ের প্রাক্কালে উত্তর ভারতের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলোতে স্বায়ত্তশাসন প্রচলিত ছিল। এসব রাজ্যের মধ্যে আফগানিস্তান, কনৌজ, সিন্ধু, কাশ্মীর, মালব, বুন্দেলখণ্ড, যোধপুর, আসাম, নেপাল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। রাজ্যের প্রাদেশিক প্রধানের পদবি ছিল ‘উপারিকা' । 

প্রত্যেক প্রদেশ কতকগুলো জেলায় বিভক্ত ছিল। জেলাকে বলা হতো 'ভাষ’আর জেলার শাসনকর্তাকে 'ভাষপতি' বলা হতো।

১০. জনসাধারণের প্রতি রাজন্যবর্গের অবহেলা : 

আরবদের সিন্ধু অভিযানের প্রাক্কালে ভারতে জনসাধারণকে রাজন্যবর্গের চরম অবহেলা করতো। তারা জনসাধারণের কল্যাণের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করতো না। তাদের এরূপ অবহেলা ও অবজ্ঞার ফলে জনবিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়। তাই প্রয়োজনের সময় ভারতীয় শাসকরা জনসাধারণের সমর্থন এবং প্রত্যক্ষ সহযোগিতা পায়নি ।


আরবদের সিন্ধু বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতের সামাজিক অবস্থা:

 ১ . ভারতীয় সমাজব্যবস্থা : 

আরবদের সিন্ধু বিজয়ের পূর্বে ভারতে আর্য, শক, কুষাণ, হূন প্রভৃতি জাতি আগমন করে। এসব জাতি প্রাচীন হিন্দু সমাজের উদারতায় মুগ্ধ হয়ে নিজেদের স্বতন্ত্র সত্তা বিসর্জন দিয়ে হিন্দু সমাজের সাথে মিশে যায়। 

এর ফলে এদেশের হিন্দু সমাজে জাতিভেদ প্রথার উদ্ভব ঘটে। অষ্টম শতকে এ প্রথা চরম আকার ধারণ করলে ভারতীয় সমাজজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

২. শিক্ষাদীক্ষা : 

আরবরা ভারত অভিযানের পূর্বে ভারতে উন্নত শিক্ষাদীক্ষা এবং কৃষ্টি-সভ্যতাও বিদ্যমান ছিল। জনগণের শিক্ষার জন্য বহু স্কুল-কলেজ স্থাপন করা হয়েছিল। পশ্চিম ভারতের বল্লভী এবং বিহারের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও উদন্তপুর, বিক্রমশীলা, বারানসি প্রভৃতি স্থানে উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। 

মালব ও আজমীরে সংস্কৃত কলেজ স্থাপিত হয়। এছাড়া জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, চিকিৎসাশাস্ত্র, দর্শন, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয় চর্চার ব্যবস্থা ছিল।

৩. বর্ণবৈষম্য প্রথা : 

কালক্রমে কঠোর বর্ণভেদ প্রথা হিন্দু সমাজের ঐক্য ও সংহতির মূলে কুঠারাঘাত করে এবং অষ্টম শতকের প্রারম্ভে হিন্দু সমাজের ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র- এ চারটি বর্ণের বিভক্তি প্রকটতর হয়। হিন্দুসমাজ এ চার বর্ণভুক্ত ছাড়া অপরাপর সকলকে অপবিত্র বা স্লেচ্ছ মনে করতো। এ বর্ণভেদ প্রথা সমাজজীবনে মারাত্মক বৈষম্যের সৃষ্টি করে।

৪. ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের প্রভাব : 

আরবদের সিন্ধু বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের প্রভাব ছিল অত্যধিক। ধর্মকর্ম, যাগযজ্ঞ এবং অন্য সকল কার্যে তাদের প্রতিপত্তি ও অধিকার ছিল প্রভূত। তারাই নিয়মনীতি প্রণয়ন করতো এবং শাসন ক্ষমতাও ছিল তাদের হাতে। 

ব্রাহ্মণরা প্রচার করতো স্মার্ত মুনি মনু আদিষ্ট হয়েছেন যে, “পৃথিবীর যেখানে যা কিছু তা ব্রাহ্মণদের সম্পত্তি বলে পরিগণিত হবে।” ঐতিহাসিক এম. হাবিবের মতে, “ব্রাহ্মণরা বলপূর্বক জনসাধারণকে অজ্ঞ করে রাখতেন। 

দুর্নীতিপরায়ণ ব্ৰাহ্মণগণ জনগণের দুর্বলতা ও ভীতির সুযোগ নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এমনকি এভাবে তারা নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতেন। ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতাপে শুধু জৈন ও বৌদ্ধগণই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেনি, নিম্নবর্ণের জনগণও অত্যাচারিত হয়। অবশেষে তারা ইসলামের ছায়াতলে এসে সামাজিক মর্যাদা লাভ করে।” 

৫. বৈশ্য ও শূদ্রদের অবস্থান : 

আরবদের সিন্ধু বিজয়ের পূর্বে ভারতের সমাজব্যবস্থায় বৈশ্য ও শূদ্ররা ছিল অধঃপতিত ও অসহায়। ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়রা তাদেরকে ঘৃণার চোখে দেখত। বেদবাক্য শুনলে কিংবা গীতা পাঠ করলে তাদেরকে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হতো। সমাজে তাদেরকে অপবিত্র ও অস্পৃশ্য বলে গণ্য করা হতো। পেশা হিসেবে বৈশ্যরা ব্যবসায়-বাণিজ্য এবং শূদ্ররা কৃষি কাজ করতো।

৬. বিবাহ প্রথা : 

তখনকার ভারতের সমাজব্যবস্থায় বিবাহ প্রথা ছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন। সে সময় ভিন্ন বর্ণের মধ্যে বিবাহ করা নিষেধ ছিল। তাই জাতিভেদ প্রথার কঠোরতা বিদ্যমান থাকায় আন্তঃসাম্প্রদায়িক বিবাহ কদাচিৎ লক্ষ করা যেত। হিন্দু পুরুষেরা একাধিক বিবাহ করতে পারত, কিন্তু বিধবাদের বিবাহ করা ছিল নিষিদ্ধ ।

৭. নরবলির প্রচলন : 

তৎকালে কতকগুলো ঘৃণ্য প্রথাকে ধর্মীয় প্রথা বলে স্বীকৃতি দেয়া হতো। নরবলি, শিশু সন্তানকে গঙ্গার জলে বিসর্জন ইত্যাদিকে পুণ্যের কাজ বলে গণ্য করা হতো। সমাজে অস্পৃশ্যতাও বজায় ছিল। ধর্মের নামে এসব ঘৃণ্য প্রথার প্রচলন করা হতো বলে জনসাধারণ সহজে তা বিশ্বাস করে মেনে নিত।

৮. সতীদাহ প্রথার প্রচলন : 

আরবদের সিন্ধু বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতের সমাজব্যবস্থায় ঘৃণ্য সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। এ প্রথা অনুযায়ী বাধ্যতামূলক মৃত স্বামীর চিতায় সদ্য বিধবাকে জ্বলন্ত আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণ করতে হতো। ধর্মের দোহাই দিয়ে সতীদাহ প্রথাকে মহাপুণ্য কর্ম বলে ধারণা করতো।

৯. নারীদের অবস্থা : 

তৎকালে ভারতে নারীদের কোনো প্রকার আত্মমর্যাদা ছিল না। তাদেরকে একমাত্র ভোগের সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তবে বৈদিক যুগে অভিজাত শ্রেণির নারীদেরকে উদার শিক্ষা প্রদান করা হতো।

গ্রিক . লেখকদের তথ্য থেকে জানা যায়, মৌর্য যুগে নারীদের অবস্থা ভালো ছিল; তারা সামাজিক মর্যাদা এবং সাহিত্য-দর্শনে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিল। কিন্তু বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত থাকায় তাদের পারিবারিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। তাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ছিল না। 

এতদসত্ত্বেও নাবালক পুত্রের অভিভাবিকা হিসেবে তাদের কখনো কখনো রাজকার্য পরিচালনা করতে দেখা যেত। সে সময় নারীদের ক্রয়-বিক্রয় করা হতো এবং রাজপ্রাসাদে ও ধনী পরিবারে তাদেরকে দাসীরূপে নিয়োগ করা হতো।

১০. দেব-দেবীর পূজার্চনা : 

আরবদের সিন্ধু বিজয়ের পূর্বে ভারত উপমহাদেশে বৌদ্ধ, জৈন, হিন্দু প্রভৃতি ধর্মের লোক বাস করলেও হিন্দুধর্মের প্রাধান্য ছিল সবচেয়ে বেশি। অধিকাংশ রাজাই ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। সে সময় হিন্দুরা বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজার্চনা করতো। নিজেদের ইচ্ছামতো বিভিন্ন মূর্তি তৈরি করে তারা সেগুলোকে দেবতা জ্ঞান করে পূজা করতো।

১১. সামন্ততন্ত্রের বিকাশ : 


সিন্ধু বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা:

১. কৃষিভিত্তিক অর্থব্যবস্থা : 

সিন্ধু বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতে কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। এ অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষ কৃষিনির্ভর ছিল । কৃষির ওপর নির্ভর করেই তারা জীবনযাপন করতো। এতে কৃষির উন্নতির মাধ্যমে রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি সাধিত হয়েছিল।

২. শিল্প বিস্তার : 

ভারতে সে সময় বিভিন্ন শিল্পেরও প্রসার ঘটে। তখন গুজরাট ও আজকের বাংলাদেশ কাপড় উৎপাদন এবং রপ্তানির জন্য বিখ্যাত ছিল। শিল্পজাত পণ্য বাজারজাতকরণের জন্য ভারতীয় বণিকরা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অন্যদেশে নির্দ্বিধায় যাতায়াত করেছে। 

ঐতিহাসিক ড. ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, “কৃষির সাথে সাথে দেশে বিভিন্ন শিল্পও যথেষ্ঠ প্রসারতা লাভ করেছিল ।”.

৩. ব্যবসায়-বাণিজ্য : 

তৎকালীন ভারতে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিস্তার ঘটেছিল। ভারত থেকে বিভিন্ন দেশে মসলা, কাপড় ও অন্যান্য দ্রব্যাদি রপ্তানি করা হতো। ভি. ডি. মহাজন বলেন, “ভারতের প্রচুর পরিমাণ ধন-ঐশ্বর্যে আকৃষ্ট হয়ে বহু বিদেশি বণিক এদেশে আগমন করে। ফলে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটে।”

৪. সমৃদ্ধ অর্থনীতি : 

এ দেশের জনগণ প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবসায়-বাণিজ্য করতো বিধায় এখানকার অর্থনীতি সমৃদ্ধ ছিল। উর্বর মাটির কৃষিভিত্তিক সমৃদ্ধ অর্থনীতির কারণেও প্রাচীন বিশ্বে ভারতবর্ষ বেশ আকর্ষণীয় দেশ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিল। 

৫.অভিজাতবর্গের জীবনযাপন: 

তৎকালে অভিজাতবর্গ বিলাসিতাপূর্ণ জীবনযাপন করতো। উন্নতমানের ভোজনে রসনাবিলাসের পাশাপাশি তাদের দৈনন্দিন জীবন ছিল চাকচিক্যে ভরপুর। 

৬. ধনসম্পদের প্রাচুর্য :

সিন্ধু বিজয়ের পূর্বে ভারতের ধনসম্পদের প্রাচুর্যের কথা রূপকথার ন্যায় প্রচলিত ছিল। ভারতের এ অফুরন্ত ধনসম্পদের মোহে এখানে আগমন করে । 

৭. গ্রামীণ অর্থনীতি : 

ভারতবর্ষে সে সময়ে নগরসভ্যতা ছিল না। তাই গ্রামগুলোই ছিল উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। গ্রামগুলো অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বনির্ভর ছিল । গ্রামের মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অভাব ছিল না। 

৮. প্রকৃতির অশুভ থাবা : 

সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে রয়েছে অসংখ্য নদ-নদী। তাই প্রকৃতি সব সময় বিরূপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত ভারতের দিকে। তৎকালের ভারতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্যা, দুর্ভিক্ষ, নদীভাঙন ইত্যাদি কারণে প্রায়ই বাধাগ্রস্ত হতো।

৯. নিম্নশ্রেণির মানুষের দুর্দশা :

ভারতীয় সমাজে সে সময় নিম্নশ্রেণির তুলনায় উচ্চশ্রেণির মানুষ ক্রমান্বয়ে ধনীতে পরিণত হয়। অন্যদিকে নিম্নশ্রেণির লোকেরা আরো নিচে নেমে যেতে থাকে। এটা প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক বৈষম্যের কুফল । 

১০. অনুষ্ঠানে অর্থের অপচয় : 

ঐতিহাসিক ড. মোহর আলী বলেন, “মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতবর্ষের জনগণ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অর্থ ব্যয়ে অপচয় করতো। কারণ তাদের অনুষ্ঠানের সংখ্যা ছিল অনেক।” 

১১. অভিশপ্ত সুদপ্রথা : 

হিন্দু সমাজে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ প্রথা প্রচলিত ছিল। এতে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্যের সৃষ্টি করে।

১২. অর্থনীতির উৎস : 

ভি. ডি. মহাজন বলেন, “মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতবর্ষে রাষ্ট্রীয় আয়ের উৎস ছিল ভূমিরাজস্ব, আবগারীশুল্ক, বাণিজ্যশুল্ক, পথকর, নৌ-কর ও অনুগত সামন্তদের নিকট হতে প্রাপ্ত কর।”

১৩. প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত অর্থনীতি : 

ভারতের জনগণ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাছে চিরদিনই অসহায় ছিল। ধন-সম্পদের প্রাচুর্য সত্ত্বেও মাঝে মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগে জনসাধারণ নিঃস্ব হয়ে যেত। ফলে সাধারণ মানুষ অনাহারে ও মহামারীতে প্রাণ হারাত।

১৪. অর্থনৈতিক বৈষম্য : 

সে সময় ভারতে অর্থনৈতিক বৈষম্য বিদ্যমান ছিল। একশ্রেণি আরামে বসে বসে খেত। বিত্তবানরা বিলাসব্যসনে জীবনযাপন করতো আর দরিদ্র কৃষকরা জীবনধারণের জন্যে কঠোর পরিশ্রম করতো।


আরবদের সিন্ধু বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতের ধর্মীয় অবস্থা:


১. জৈন, বৌদ্ধ ও হিন্দুধর্ম : 

জৈনধর্ম তেমন জনপ্রিয় ছিল না। এ ধর্মের অনুসারী ছিল খুবই অল্পসংখ্যক। বৌদ্ধধর্মও লুপ্তপ্রায় অবস্থায় উপনীত হয়েছিল। সে তুলনায় হিন্দুধর্ম দেশের প্রধান ধর্মে পরিণত হয়েছিল। প্রায় সারা উপমহাদেশেই এ ধর্মের অনুসারীদের অবস্থান ছিল। হিন্দু শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দুধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটে।

২. ধর্মীয় শাখার উদ্ভব : 

সিন্ধু বিজয়ের পূর্বে ব্রাহ্মধর্মের শেষ যুগে ভারতে শৈব ও বৈষ্ণব নামে দুটি ধর্মীয় শাখার উদ্ভব হয়। এসব ধর্মীয় শাখার অনুসারীদের মধ্যে পারস্পরিক প্রাধান্য বিস্তারের লক্ষ্যে শ্রেণিগত বিবাদ-বিসংবাদ লেগেই থাকতো। তাদের এ বিবাদ-বিসংবাদের সুযোগেই মুসলিম শাসকগণ তাদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয় ।

৩. জাতিভেদ প্রথা : 

প্রথমত হিন্দুধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটলেও জাতিভেদ প্রথার কারণে এ ধর্ম অনেকটা ঝিমিয়ে পড়ে। কারণ জাতিভেদ প্রথা ধর্মীয় আদর্শের মর্মমূলে মারাত্মকভাবে আঘাত হানে। 

তখন বৈশ্য, শূদ্র ও নিম্নশ্রেণির হিন্দুরা ছিল নির্যাতিত, নিষ্পেষিত ও অস্পৃশ্য। ড. দীনেশচন্দ্র সেন বলেন, পণ্ডিত ব্রাহ্মণগণ ক্ষমতায় মদমত্ত হয়ে অত্যাচারীর ভূমিকা গ্রহণ করে।

৪. ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য : 

হিন্দু প্রথা অনুযায়ী ব্রাহ্মণগণ ছিল সমাজে উচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। সাধারণের ভাগ্যনিয়ন্ত্রক হিসেবে ব্রাহ্মণগণ সমাজের উচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত ছিল। তাদের নির্দেশানুযায়ী সমাজে যাগযজ্ঞ, পূজা অর্চনা ও অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবের আয়োজন করা হতো। সাধারণ মানুষের জ্ঞানার্জন বা ধর্মগ্রন্থ পাঠের কোনো অধিকার ছিল না।

৫. প্রচলিত কুসংস্কার : 

হিন্দুধর্মের বিধান অনুযায়ী তখন সমাজে নানা কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। স্ত্রীর পূর্বে স্বামী মারা গেলে মৃত স্বামীর চিতায় স্ত্রীকেও জ্যান্ত পোড়ানো হতো, যা ছিল মারাত্মক বর্বরোচিত ও জঘন্যতম অপরাধ। এছাড়াও বাল্যবিবাহ, গঙ্গায় সন্তান বিসর্জন ইত্যাদি জঘন্য বিধান প্রচলিত ছিল।

৬. মূর্তিপূজার প্রাধান্য : 

মূর্তিপূজা ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান আরাধ্য বিষয় । এ সময় হিন্দুগণ সৃষ্টিকর্তা হিসেবে ব্রহ্মা, পালনকর্তা হিসেবে বিষ্ণু এবং সংহারকর্তা হিসেবে শিবের পূজা করতো। তাছাড়া সে সময় তারা অগ্নি, সূর্য এবং বৃক্ষেরও পূজা করতো ।

উপসংহার : 

আরবদের সিন্ধু বিজয়ের পূর্বে ভারত অর্থ-সম্পদে ভরপুর একটি দেশ হলেও এর রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। কেন্দ্রীয় শাসনের অভাব, রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত ভারতীয় উপমহাদেশের ঐক্য ও শক্তিকে চরমভাবে বিনষ্ট করে তুলে। 

ভারতীয় উপমহাদেশের অফুরন্ত সম্পদ ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ এ অবস্থাই মুসলমানদের ভারতবর্ষ জয়ের পথ সুগম করে থাকে।



ইসলামের ইতিহাস ইসলামের ইতিহাস ইস ইসলামের ইতিহাস ইসলামের ইতিহাসলামের ইতিহাস ইসলামের ইতিহাস ইসলামের ইতিহাস ইসলামের ইতিহাস ইসলামের ইতিহাস ইসলামের ইতিহাস ইসলামের ইতিহাস ইসলামের ইতিহাস ইসলামের ইতিহাস ইসলামের ইতিহাস ইসলামের ইতিহাস

নিত্য নতুন সকল আপডেটের জন্য জয়েন করুন

Telegram Group Join Now
Our Facebook Page Join Now
Class 8 Facebook Study Group Join Now
Class 7 Facebook Study Group Join Now
Class 6 Facebook Study Group Join Now

Post a Comment