প্রশ্ন: প্রাচ্য শব্দটি কিভাবে বাংলায় বিবর্তন হয়েছে? প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় গ্রিকদের অবদান সমূহ | How has the word Oriental evolved in Bengali? Contributions of the Greeks to Oriental Political Thought
উত্তর : ভূমিকা : প্রাচ্য রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে ধর্ম ও নৈতিকতার সামঞ্জস্য থাকলেও প্রকৃতপক্ষে ততটা ধর্মকেন্দ্রিক নয়। কেননা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে ধর্ম ও রাষ্ট্রনীতিকে এক করে দেখা হয়নি। তাছাড়া মধ্যযুগে প্রাচ্যের মুসলিম চিন্তাবিদগণ প্লেটো ও এরিস্টটলের ধারণার সাথে মুসলিম দর্শনের সমন্বয় সাধন করেছেন। এক্ষেত্রে প্রাচ্য রাষ্ট্রচিন্তার বেশকিছু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।
প্রাচ্য শব্দটি যেভাবে বাংলায় বিবর্তন হয়েছে :
প্রাচ্য শব্দটি প্রাচী থেকে এসেছে । প্রাচী অর্থাৎ পূর্ব দিক। প্রাচী+ ষ্ণ =প্রাচ্য (অর্থাৎ পূর্ব দিকের সহিত সম্বন্ধি) প্রাচ্য শব্দটি বিশেষ্য ও বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় । ভারতীয় উপমহাদেশ হল প্রাচ্য সভ্যতার কেন্দ্রস্থল । প্রাচ্যবিদ্যা মানে বেদ ও উপনিষদের মধ্যে অন্তর্নিহিত জ্ঞান । এখানে প্রাচ্য বিশেষণ ।
মধ্যপ্রাচ্য অর্থাৎ এশীয় মহাদেশে অবস্থিত- তুরস্ক থেকে পারস্য ভূখণ্ড যেখানে ভারতের পরবর্তীতে সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল । প্রায় সমসাময়িক ব্রহ্মদেশ থেকে ভিয়েতনাম ফিলিপিন্স দ্বীপপুঞ্জ (ইন্দোনেসিয়া সহ) তে সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল । এই সম্পূর্ণ এলাকা হল দূরপ্রাচ্য । এখানে প্রাচ্য বিশেষ্য ।
পশ্চাত্ মানে পিছনে।
পশ্চাত্ +ষ্ণ= পাশ্চাত্য অর্থাত্ প্রাচ্যের বিপরীত দিকে অবস্থিত ভূখণ্ড বা মহাদেশ অর্থাত্ ইউরোপ (বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ) যেখানে ভিন্ন সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল ।
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা নিয়ে আরো বিস্তারিত জানতে এই পোষ্টটি পড়ুন : প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা এর পাঠের গুরুত্ব, প্রধান বৈশিষ্ট্য, পরিধি ও বিষয়বস্তু
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ:
১. আদর্শবাদ :
আদর্শবাদ প্রাচ্য রাষ্ট্রচিন্তার প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রাচ্যের চীনে কনফুসিয়াসের আদর্শকে কেন্দ্র করে আদর্শবাদ তত্ত্বের
উদ্ভব ঘটে। তাছাড়া মধ্যযুগে ইসলামি ভাবধারার আদলে আদর্শবাদী ভাবধারা গড়ে উঠে। ২. নীতিবাদ প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা যতটা না রাজনৈতিক তার চেয়ে নৈতিক প্রকৃতির। প্রাচীন ভারতের ভানুসংহিতা, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, কনফুসিয়াস, লাওৎসের ভাবধারা এবং ইসলামের সকল কাজে নৈতিকতার উপদেশ বাণী পাওয়া যায়।
৩. অভিজ্ঞতাবাদ:
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অভিজ্ঞতাবাদ। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার নিদর্শন পাওয়া যায়। কনফুসিয়াসের রাজনৈতিক চিন্তাধারা তার অভিজ্ঞতার ফসল। পরবর্তী রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ রাষ্ট্রদর্শনের গবেষণায় অভিজ্ঞতাবাদকে কাজে লাগান। তাছাড়া উপনিষদ, মহাভারত, জাপানে মেইজি রেস্টোরেশনে অভিজ্ঞতাবাদের প্রভাব দৃশ্যমান।
৪. ন্যায়বিচার:
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো ন্যায়বিচার। প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ তাদের গবেষণা, লেখনিতে ন্যায়বিচারের কথা উল্লেখ করেছেন। কনফুসিয়াসের রাষ্ট্রদর্শনের অন্যতম দিক ছিল ন্যায়বিচার। তিনি ন্যায়পরায়ণ রাজা ও রাজতন্ত্রকে লালন করার কথা বলেছেন। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও রাজাকে ন্যায়পরায়ণ হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর ইসলামের রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল দর্শন হলো ন্যায়বিচার ।
৫.ধর্মের প্রাধান্য:
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার উপর ধর্মের প্রভাব কম নয়। কনফুসিয়াসের রাজনৈতিক চিন্তাধারা সমাজজীবনে ধর্মীয় নীতি হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। তাওবাদের দর্শন ও ধর্মকেন্দ্রিক চিন্তাধারার বিকাশ ঘটায়। মহাত্মা গান্ধীর সর্বোদয় আর সত্যাগ্রহ সবই ধর্ম উদ্ভূত চিন্তা। ইসলাম ধর্ম-রাষ্ট্রীয় জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। মুসলিম শাসন ও চিন্তাবিদগণ ধর্মকেন্দ্রিক ভাবধারার উদ্ভব ঘটান।
৬. মানবতাবাদ:
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় মানবতাবাদের নিদর্শন লক্ষ্য করা যায়। প্রাচ্যের দার্শনিক কনফুসীয় দর্শনে মানবতাবাদে উল্লেখ করা হয়। এখানে ব্যক্তির অধিকারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়। আধুনিক ভারতের রাষ্ট্রচিন্তাবিদ এম এন রায়ের দর্শনেও মানবতাবাদের প্রমাণ মেলে।
৭. সুশাসন:
পাশ্চাত্যে রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের লেখায় রাজতন্ত্রের স্বেচ্ছাচারিতার নজির পাওয়া যায়। কিন্তু প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় সুশাসনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কনফুসিয়াস রাষ্ট্রে সুশাসন নিশ্চিত করতে শাসককে নির্দেশ দিয়েছেন। মুসলিম শাসকগণ বিশেষ করে হযরত উমর (রা.)-এর সুশাসন রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে বিশেষ নমুনা বহন করে।
৮. রক্ষণশীলতা :
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা রক্ষণশীলতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ। প্রাচ্যের সমাজব্যবস্থায় কনফুসিয়াস, মহাত্মা গান্ধী ও মধ্যযুগের মুসলিম শাসকদের দর্শন চিন্তা অপরিবর্তিত রয়েছে।
৯. আন্তর্জাতিকতা:
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা আন্তর্জাতিকাবাদে বিশ্বাসী। ইসলামের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বৈদেশিক সম্পর্ক, ভ্রাতৃত্ব, এক রাষ্ট্রের সাথে অন্য রাষ্ট্রের সম্পর্ক, কূটনৈতিক তৎপরতা, পররাষ্ট্রনীতি আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিচায়ক।
রাষ্ট্রচিন্তায় গ্রিকদের অবদান:
বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতাসমূহের মধ্যে গ্রিক সভ্যতা শীর্ষস্থানীয়। এ সভ্যতায় যেসব মনীষীর আবির্ভাব ঘটেছে তাঁদের প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি পরবর্তীকালের পাশ্চাত্য সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছে বহুগুণে। স্বাধীনতা, সাম্য, গণতন্ত্র, নিয়মতান্ত্রিকতা, আইন সার্বভৌমত্ব প্রভৃতি সম্পর্কে গ্রিকরা যেসব তথ্য দিয়েছেন তা আজও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। তাই বলা যায়, গ্রিকদের হাত ধরেই রাষ্ট্রচিন্তার উদ্ভব।
রাষ্ট্রচিন্তায় গ্রিকদের অবদান: নিম্নে রাষ্ট্রচিন্তায় গ্রিকদের অবদান আলোচনা করা হলো-
১. রাষ্ট্র সম্পর্কে ধারণা :
গ্রিকরাই সর্বপ্রথম রাষ্ট্রসম্পর্কিত ধারণার সূত্রপাত ঘটায়। তারাই রাষ্ট্রের উৎপত্তি, প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনা করে, তাছাড়া রাষ্ট্রের কার্যাবলি সম্পর্কেও তারা আলোচনা করে। তাছাড়া রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যে কেমন সম্পর্ক থাকবে সে সম্পর্কেও তারা মতামত প্রদান করেন।
২. স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র :
গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার একটি বিশেষ অবদান হলো স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র। গ্রিকদের মধ্যে রাজনৈতিক স্বাধীনতার যে স্পৃহা ছিল তা পূর্ববর্তী কোনো দেশে দেখা যায়নি। গণতন্ত্রের ক্রমবিকাশেও গ্রিকদের অবদান অত্যন্ত প্রশংসনীয় । রাষ্ট্রীয় কাজে সকল নাগরিকের অংশগ্রহণের ফলে তাদের সমাজব্যবস্থাও গণতান্ত্রিক চরিত্র লাভ করে ।
৩. ব্যক্তি স্বাধীনতা :
গ্রিকরাই সর্বপ্রথম ব্যক্তিস্বাধীনতার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে। এরিস্টটল বলেন যে, “মানুষ যদি তার পূর্ণতার চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত করতে হয়, তাহলে তাকে অবাধ স্বাধীনতা দিতে হবে। কারণ স্বাধীনতা কোনো ব্যক্তিসত্তা পরিপূর্ণভাবে বিকাশ লাভ করতে পারে না।
৪. আইনের প্রতি শ্রদ্ধা :
আইনের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করা গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। তারাই সর্বপ্রথম আইন মানার গুরুত্ব অনুধাবন করে। তাঁদের মতে, আইন প্রকৃতির উৎস এবং মানব প্রজ্ঞা প্রকৃতির ইচ্ছে আবিষ্কারের উপায়। রাষ্ট্রের সকলে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবো।
৫. ন্যায়বিচার :
সর্বপ্রথম গ্রিক রাষ্ট্রদর্শনেই ন্যায়বিচার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় এবং ন্যায়বিচারের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। গ্রিকদের মতে, যারা যা প্রাপ্য তাকে তা দেয়াই ন্যায়বিচার। তাদের মতে, যদি সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা না হয় তবে সমাজে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। তাদের ন্যায়বিচার ধারণা আধুনিক ন্যায়বিচার ধারণার পথিকৃৎ ।
৬. নৈতিকতা :
প্রাচীন গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য হলো রাষ্ট্রে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করা। তারা আইন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় পুরাকথা, ধর্ম, নৈতিকতা প্রকৃতির উপর সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি তারা রাজনৈতিক কার্যাবলিতেও ধর্মের নিয়মনীতি অনুসরণের তাগিদ দিয়েছেন। তাদের এ অবদান বর্তমানেও আলোচনার বিষয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তা হলো আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার পথিকৃৎ ও মূলভিত্তি। মূলত রাষ্ট্রচিন্তার উৎপত্তিই প্রাচীন গ্রিসের নগর রাষ্ট্রগুলোতে এ রাষ্ট্রচিন্তায় গ্রিকদের এতসব অবদান থাকা সত্ত্বে ও শেষ পর্যন্ত গ্রিসের নগর রাষ্ট্রগুলো সাম্রাজ্যবাদী চেতনায় মত্ত হয়ে উঠায় তাদের পতন ঘটে। এজন্য অনেক ঐতিহাসিক গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তাকে অমূর্ত আদর্শ বলে ব্যাখ্যা করেছেন।
প্রাচ্য শব্দটি কিভাবে বাংলায় বিবর্তন হয়েছে ? প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় গ্রিকদের অবদান সমূহ, প্রাচ্য শব্দটি কিভাবে বাংলায় বিবর্তন হয়েছে ? প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় গ্রিকদের অবদান সমূহ, প্রাচ্য শব্দটি কিভাবে বাংলায় বিবর্তন হয়েছে ? প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় গ্রিকদের অবদান সমূহ
নিত্য নতুন সকল আপডেটের জন্য জয়েন করুন
If any objections to our content, please email us directly: helptrick24bd@gmail.com