প্রশ্ন ॥ তিতুমীরের বিদ্রোহ ছিল বাংলার প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন- ব্যাখ্যা কর। Titumir's Rebellion was the first independence movement of Bengal- Explain.
ভূমিকা : পলাশির আম্র কাননে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হলে ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত তারা নানা কূটকৌশল ও ছলচাতুরির মাধ্যমে ভারতবর্ষে তাদের সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী নীতি বাস্তবায়ন করতে থাকে।
ব্রিটিশদের চিরস্থায়ী ভূমি বন্দোবস্ত নীতি ভারতবর্ষের সমৃদ্ধশালী কৃষকদের সর্বস্বান্ত করে ভূমিহীন কৃষকে পরিণত করে। তাছাড়া ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশীয় জমিদার, নীলকর ও মহাজনরা কৃষকদের রক্তচুষে নিচ্ছিল।
তিতুমীর এই সকল জমিদার, জোতদার, নীলকর তথা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যারা গণআন্দোলন গড়ে তুলেছিল তাদের মধ্যে তিতুমীর ছিলেন অন্যতম বীর সেনানী। তিনিই প্রথম বাংলায় ব্রিটিশ বিরোধী সফল আন্দোলন গড়ে তোলেন।
বাংলার প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন হিসেবে তিতুমীরের বিদ্রোহ :
১৭৯৩ সালে লর্ড কর্ণওয়ালিশ কর্তৃক প্রবর্তিত চিরস্থায়ী ভূমিবন্দোবস্ত নীতি ভারতবর্ষের বিরাট সংখ্যক সচ্ছল কৃষকের আর্থিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী ভূমিবন্দোবস্ত নীতির ফলে ভারতবর্ষের সমৃদ্ধশালী কৃষকেরা ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হয়।
তাছাড়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দোসর জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচারে কৃষকদের দুঃখ-দুর্দশার অন্ত ছিল না। নীলকর, জমিদার, জোতদারদের অত্যাচার দিন দিন বাড়তেই থাকে। ফলে দিন দিন কৃষকের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে।
তিতুমীর এই সকল অত্যাচারী জমিদার, নীলকরদের হাত থেকে ভারতবর্ষের কৃষকদের মুক্তির সংগ্রামে শামিল হয়ে ছিলেন। তিতুমীরের সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল।
তিনি তার সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন মুসলমান কৃষক ও প্রজাদের মধ্যে থেকে কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও গোঁড়ামি দূর করেন; অন্যদিকে তিনি কৃষদের কে একটি সংগঠিত করতে থাকেন।
অত্যাচারী জমিদার, জোতদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তিতুমীর কৃষকদের সামরিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তিনি তাঁর অনুসারী কর্মীদের সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। বাংলার প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন
সামরিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কৃষকেরা তিতুমীরের নেতৃত্বে অত্যাচারী জমিদার, নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলনে সোচ্চার হয়ে ওঠে। অত্যাচারী জমিদার ও নীলকর বাহিনী তিতুমীরের গণবাহিনীর সাথে মুখোমুখি সংঘাতে পরাজিত হতে থাকেন। প
রাজয়ের গ্লানি তাদের উত্তেজিত ও খ্যাপিয়ে তোলে। পরাজিত জমিদার ও নীলকররা তিতুমীরকে দেশদ্রোহী বলে আখ্যা দিতে থাকেন। তিনি কোনো কিছুর পরোয়া না করে দৃঢ় সাহস ও মনোবল নিয়ে অত্যাচারী জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে থাকেন।
কেননা তিনি তার দূরদৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে এটা সহজেই উপলব্ধি করতে পারেন যে, জমিদার, জোতদার, নীলকর ও ব্রিটিশদের অন্যায় শাসন, শোষণ ও নির্যাতনের যাতাকল থেকে কৃষকদের মুক্তি দিতে না পারলে ভারতবর্ষের কৃষকদের ভাগ্য উন্নয়ন হবে না। বাংলার প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন
সুচতুর ও কূটকৌশলে দক্ষ ব্রিটিশরা সহজেই তিতুমীরের স্বাধীনতাকামী অভিলাষ বুঝতে পারেন এবং তার বিরুদ্ধে জমিদার শ্রেণি কর্তৃক আনীত দেশদ্রোহীতার অভিযোগকে সত্য বলে ধরে নেন।
তিতুমীরের আত্মপক্ষ সমর্থনের বক্তব্য সন্তুষ্ট করতে পারেনি এবং তারা তার বক্তব্যের প্রতি কর্ণপাতও করেনি। এমনকি ব্রিটিশ সরকার তাকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার হুমকি প্রদান করেন। ব্রিটিশ সরকারের এই ন্যায়-নীতিহীন ও হঠকারী সিদ্ধান্ত তিতুমীরকে উদ্বিগ্ন ও বিচলিত করে তোলে।
তাই তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে শক্তি সঞ্চয় করে চব্বিশ পরগনা, নদীয়া ও ফরিদপুর জেলার কিছু অংশ নিয়ে একটি স্বাধীন অঞ্চল গঠনের জন্য কাজ করতে থাকেন। তিনি নিজেকে এ অঞ্চলের বাদশা ঘোষণা করেন এবং জমিদার ও ব্রিটিশ সরকারকে কর না দিতে তিনি তার অনুসারী ও অন্যান্য কৃষক, প্রজাকে নিষেধ করেন। বাংলার প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন
ফলে প্রত্যক্ষভাবে ব্রিটিশদের সাথে তার বিরোধের সূচনা হয়। তিতুমীর ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহে ফেটে পড়েন। ইতিহাসের পাতায় এটি 'বারাসাত' বিদ্রোহ নামে পরিচিতি লাভ করে। তিতুমীরের দৃঢ়, গতিশীল ও শক্তিশালী নেতৃত্বে ব্রিটিশ বিরোধী এক প্রবল আন্দোলন গড়ে ওঠে।
হাজার হাজার কৃষক তার নেতৃত্বে সংগঠিত হতে থাকে এবং তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। ব্রিটিশ পন্থি জমিদার ও নীলকররা তিতুমীরের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত ও ভীত হয়ে তার অনুসারী কৃষকদের ওপর অন্যায়ভাবে নানা অতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে দিতে থাকে।
ব্রিটিশ পন্থি এক হিন্দু জমিদার মুসলমান প্রজাদের দাড়ির ওপর আড়াই টাকা হারে জন প্রতি কর আরোপ করেন। তিতুমীরের অনুসারীরা এই কর না দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে জমিদাররা প্রতিহিংসাবসত মুসলমান প্রজাদের বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা দিতে থাকে।
যার অধিকাংশই আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হতে থাকে। শান্তিপূর্ণ পন্থায় জমিদার, জোতদার, নীলকর ও ইংরেজদের অন্যায়, অত্যাচার, শাসন, শোষণের অবসান না হওয়ায় তিতুমীর সশস্ত্র আন্দোলনের পথে অগ্রসর হন।
এজন্য তিনি ১৮৩১ সালে কলকাতার নিকটবর্তী নারিকেলবাড়িয়ায় একটি বিপ্লবী কেন্দ্র স্থাপন করে তার চতুর্দিকে একটি বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেন যা ইতিহাসে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা নামে পরিচিতি লাভ করে। তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা ছিল দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্রে পরিপূর্ণ।
মটনার ব্যাপকতা ও জমিদার, নীলকরদের আবেদনে ব্রিটিশ সরকারে টনক নড়ে। তাই ব্রিটিশ সরকার তিতুমীরকে দমন করার জন্য বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডারের নেতৃত্বে এক বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে নারিকেলবাড়িয়ার বাঁশের কেল্লায় আক্রমণ চালায়।
ফলে তিতুমীরের সাথে আলেকজান্ডারের বাহিনীর সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষে ব্রিটিশবাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। তারপর এই সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে তিতুমীরের বাহিনী নীলকর ও জমিদারদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অভিযান পরিচালনা করতে থাকে। বাংলার প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন
ভীতসন্তয় কুঠিয়ালরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যা। ১৮৩১ সালের ১৭ নভেম্বর বারাসাতের ম্যাজিট্রেট আলেকজান্ডার ৩০০ সৈন্য নিয়ে আবারও তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা আক্রমণ করেন। তিতুমীরের গণবাহিনী এই সৈন্য দলকে পরাজিত ও বিতাড়িত করে দেয়। বাংলার প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন
তারপর ব্রিটিশ সরকার বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার ও মেজর স্কটের অধীনে পদাতিক, অশ্বারোজী, বন্দুকধারী ও একটি কামানের গোলন্দাজ বাহিনী প্রেরণ করেন। এই বাহিনীর গোলন্দাজদের কামানের গোলায় তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা ভেঙে যায় এবং কামানের গোলার আঘাতে তিতুমীরের মৃত্যু হয়। বাংলার প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন
তিতুমীর সহ তার আরও ৪০ জন সহচর শাহাদত বরণ করেন। ইংরেজরা তিতুমীরের প্রধান সেনাপতি গোলাম মাসুদকে ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত করেন। আরও অনেক যুদ্ধ বন্দিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করা হয়। বাংলার প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন, বাংলার প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন
নিত্য নতুন সকল আপডেটের জন্য জয়েন করুন
If any objections to our content, please email us directly: helptrick24bd@gmail.com