কিশোর গল্প : ক্রাইসিস | Kishor Golpo Crisis
কয়েক মিনিটের মধ্যেই গোটা বাড়িটা নিশ্চুপ হয়ে গেল। যেন একটু আগেই কারও প্রাণবিয়োগ হয়েছে। অথচ সেরকম কিছুই ঘটেনি। ঘটবার কথাও নয়। খানিক আগেও কত হইচই। বাড়ি গমগম করছিল। এর কথা ওর কথাকে চাঁটি মেরে বসিয়ে দিতে চাইছিল।
সানাইয়ের শব্দ, শাঁখ, উলুধ্বনি, নেদোমামার বাজখাঁই গলার পুলিশি চিৎকার সব মিলিয়ে বিয়েবাড়ি জমজমাট। অথচ এই মুহূর্তে এই সাতের দশ বাই সি, হরিদাস সিদ্ধান্ত লেনের একশো পাঁচ বছরের পুরোনো বাসিন্দা ব্রজশেখর দত্ত-র অধস্তন চার পুরুষ কীর্তিশেখর দত্ত-র বিশাল বাড়িটায় যেন পিন পড়লেও শোনা যায়।
বাড়ির পোষা গোরু ছাগল কুকুরগুলোও যেন আফিমের গুলি খেয়ে ঝিম মেরে পড়ে আছে। দুপুলবেলায় শ দেড়েক পাত পড়ার কথা। রাতে সাড়ে চারশো। পিছনের উঠোনে তিনটে ঠাকুর আর পাঁচটা হেল্পার মিলে দক্ষযজ্ঞ বাধিয়ে বসেছিল। তারাও চুপ।
এমনকি বাড়ির বারো চোদ্দোটা কুঁচোকাঁচা অব্দি। কীর্তিশেখর বসার ঘরের শতরঞ্চিতে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। বড়ো ছেলে সৌম্যশেখর তার বউয়ের সঙ্গে মনোযোগ দিয়ে কিছু আলোচনা করছে। ছোটো ছেলে দিব্যশেখর ভাঁড়ার ঘরের সামনের টুলটায় যেমন বসেছিল তেমনই বসে আছে।
নির্বাক, নিস্পন্দ, কীর্তিশেখরের একমাত্র শ্যালক, মানে সৌম্য আর দিব্যর একমাত্র মামা, যিনি রান্নার তদারকি করছিলেন, গম্ভীরমুখে বাইরের রাস্তায় পায়চারি করছেন। বাড়ির মেয়ে বউরা কনেকে, মানে সৌম্যশেখরের একমাত্র মেয়ে দোয়েলকে নিয়ে ব্যস্ত।
গিন্নিমা এসে কীর্তিশেখরের সামনে দাঁড়ালেন। কিশোর গল্প ক্রাইসিস
– কিছু বলবে?
–বলব মানে! তোমাদের আক্কেলটা কী? এতখানি বেলা হয়ে গেল। বাচ্চা মেয়েটা উপোস করে বসে আছে। পাড়ার লোকজন আসতে শুরু করেছে। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে তো, না কী?
গিন্নিমা দাপাতে দাপাতে চলে গেলেন। কীর্তিশেখর উঠে দাঁড়ালেন। সদর দরজায় নেদোমামার পুলিশি গলা শোনা গেল। অ্যাবসার্ড, রিডিক্যুলাস, অবনক্সাস। হবে না, হবে না। এসব অপদার্থ অকালকুষ্মাণ্ডদের দিয়ে কিস্যু হবে না । —কী হয়েছে নেদো? অত চ্যাঁচাচ্ছ কেন? এনি প্রবলেম?
—চ্যাচাব না তো কী করব? ওদের কোলে বসিয়ে আদর করব? মুখেই জগৎ মারে। বড়ো বড়ো বাক্যি। আপনিই বলুন জামাইবাবু .......
—আরে কী হয়েছে বলবে তো।
—কী আর বলব বলুন। এদের তো দেখছি আবার নতুন করে ব্যাট ধরা শেখাতে হবে। সব নাকি কোটি টাকার পেলেয়ার। আবার ভিয়েন করে গাবিয়ে বেড়ায় ‘টিম ইন্ডিয়া'।
দশ ওভারের মধ্যে চারখানা উইকেট খুইয়ে বসে আছে। দেড়শোও করতে পারবে না, দেখে নেবেন। আমরা যখন খেলতাম তখন একটা নিষ্ঠা ছিল। পারসিভিয়ারেন্স, সিন্সেরিটি, ডিলিজেন্স,
— শব্দগুলো ভ্যানিশ হয়ে গেল ওদের ডিকশনারি থেকে? মুস্তাক-মার্চেন্ট-নাইডুদের পা ধোয়া জল খাওয়া উচিত। যত্তোসব আনগ্রেটফু.....। কিশোর গল্প ক্রাইসিস
নেদোমামাকে চুপ করিয়ে দিয়ে কীর্তিশেখর বললেন—ঠিক আছে নেদো, ওসব কথা শোনার বা বলার সময় এখন নয়। একটা বিরাট ক্রাইসিস সৃষ্টি হয়েছে। মুখে চুনকালি লাগার ব্যবস্থা প্রায়। কিছু একটা করো। কিশোর গল্প ক্রাইসিস
নেদোমামা তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন— ক্রাইসিস! দেখুন জামাইবাবু, ক্রাইসিস বলে কোনো ওয়ার্ড এই নেদোর ডিকশনারিতে নেই। কোনোদিন ছিল না।
পঁয়ত্রিশ বছর পুলিশে চাকরি করেছি, কত বড়ো বড়ো দায়িত্ব পালন করেছি, কত চিফ মিনিস্টারের সঙ্গে ওঠা বসা করেছি, ক্রাইসিস কোনোদিন ফেস করেছি বলে মনে হয় না।
ক্রাইসিস কাকে বলে জানেন? দশ ওভারের মধ্যে চার উইকেট ধসিয়ে দিয়ে রান করেছে চোদ্দো। এটাই হল ক্রাইসিস।
পারবে এখান থেকে খেলাটা ধরতে? ইম্পসিবল! বেট ধরতে রাজি আছি। এখান থেকে ম্যাচ বের করতে পারাটাই হল ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট, বুঝলেন জামাইবাবু।
কীর্তিশেখর তাঁর এই পুলিশ শ্যালকটিকে ভালো করেই জানেন। যেটা নিয়ে পড়বে তার দফারফা করে ছাড়বে। কিশোর গল্প ক্রাইসিস
খুব শান্তভাবে গলাটা মোলায়েম করে বললেন–আঃ নেদো, তোমার সবতাতে এই ক্রিকেটকে টেনে আনাটা আমার মাঝে মাঝে ভালো লাগলেও এখন ভালো লাগছে না।
কত বড়ো একটা সমস্যার সামনে পড়েছি জান ?আধঘণ্টার মধ্যে খেতে বসানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আর এখন এই অবস্থা। এখুনি একটা......। কিশোর গল্প ক্রাইসিস
কী সমস্যা সেটা বলবেন তো। নেদো সেনের কাছে কোনো সমস্যা সমস্যাই নয়। খাঁটি বদ্যির বাচ্চা। কাকে অ্যারেস্ট করতে হবে বলুন। এক্ষুনি ডি. জি.-কে লাইনে ধরছি।
নেদোমামা বুকপকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে টেপাটেপি করতে যাবেন, কীর্তিশেখর বললেন, নেদো যেভাবেই পার, যাকে দিয়ে পার আধঘণ্টার মধ্যে মিষ্টির ব্যবস্থা করো। হাজার পিস পান্ডুয়া এখুনি চাই।
দুপুরে খাওয়ার জন্য না হয় পাড়ার চারটে দোকান থেকে যা পাওয়া যাবে তাই দিয়ে ব্যবস্থা করে চালিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু রাত্তিরের খাওয়া? তার জন্য তো মিষ্টির ব্যবস্থা করতেই হবে।
না হলে তো মান থাকবে না। হাজার পিস পান্ডুয়া কি মুখের কথা? তুমিই পারবে নেদো। এই মুহূর্তে এটাই এ বাড়ির ক্রাইসিস। ম্যানেজ করো। কিশোর গল্প ক্রাইসিস
—মিষ্টি? পান্ডুয়া? মানে সুইটস ? কেন? ভোরবেলায় তো 'কমলা সুইটস' থেকে ডালডার টিনে করে মিষ্টি ডেলিভারি দিয়ে গেল। কী হল সেগুলোর? ভ্যানিশ ?
—আর বোলো না। পান্ডুয়ার গায়ে ইঁদুরে না কিসে যেন দাঁত বসিয়েছে। ওই পান্তুয়া লোককে দেওয়া যাবে না। বেশিরভাগ পান্ডুয়ার গায়ে অনেকগুলো করে ফুটো।
—তার মানে, আপনি, জামাইবাবু, বলতে চাইছেন যে পান্তুয়াস আর ড্যামেজড? ডিলাপিডেটেড? বাট হাউ? দায়িত্বে কে ছিল? ইন হুজ কাস্টডি ?
কীর্তিশেখর ঠিক কীভাবে শুরু করবেন বুঝতে পারছিলেন না। হাজার হোক নিজের ছেলে বলে কথা। দিব্যর ওপরেই তো ভাঁড়ার ঘরের দায়িত্ব ছিল। চাবিও ওর কাছে ছিল।
আমতা আমতা করে বললেন, দিব্যর কাছেই ভাঁড়ারের চাবি ছিল। ভোরবেলা যখন মিষ্টি ডেলিভারি দিয়ে গেল তখনই দিব্যকে বলেছিলাম মিষ্টির টিনদুটো ছাগলের ঘরে রেখে তালা বন্ধ করে রাখতে।
আচমকা সামনে গাড়ি এসে সজোরে ব্রেক মারলে যেমন অবস্থা হয়, সেরকম চমকে গিয়ে নেদোমামা বললেন, সারপ্রাইজিং, অ্যামেজিং! ছাগলের ঘরে? মানে গোট্স রুম?
কী বলছেন জামাইবাবু! ছাগলের ঘর কি পান্ডুয়া রাখার জায়গা হল? আর দেখতে হবে না। সব কীর্তি ছাগলের। চলুন তো গিয়ে দেখি। ছাগলের কান দেখলেই আমি বলে দেব কটা পান্ডুয়া খেয়েছে। কটা ছাগল আছে বলুন তো। —বলছি, বলছি। কিশোর গল্প ক্রাইসিস
তার আগে নেদো তোমার ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টটা দেখাও তো একবার। এক্ষুনি পান্ডুয়ার ব্যবস্থা করো। দুপুরে খাওয়ার মিষ্টি আনতে আমি ভানুকে পাঠিয়ে দিয়েছি।
তুমি দিব্যকে নিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরোও। যেখান থেকে পারো হাজার পিস পান্ডুয়া এনে হাজির করো। এ নাও টাকা।
—জাস্ট অ্যা মিনিট।
নেদোমামা মোবাইল ফোন থেকে দু-মিনিট কথা বলে ফোনটা বুকপকেটে রাখলেন। একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন—ডান। জামাইবাবু, ডা-আ-ন। নেদো সেনকে লোকে এখনও ভোলেনি।
বাগবাজারের 'সুইটস ইন্ডিয়া'কে বলে দিলাম। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে থাউজেন্ড অ্যান্ড ফিফটি পিসেস পান্ডুয়া চলে আসছে।
পঞ্চাশ পিস ফর টেস্টিং, হাজার পিস ইনট্যাক্ট ফর অতিথিস অ্যান্ড অভ্যাগতস। দিস ইজ নেদোজ ক্যারিশমা। নো পেমেন্ট রাইট নাউ, জামাইবাবু। আগে খেয়ে পরে দাম।
কীর্তিশেখর হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। নেদোমামাকে জড়িয়ে ধরে বললেন
—তুমি আমার মান বাঁচালে, নেদো। একেই বলে শালা। এইজন্যেই লোকে বউয়ের চেয়ে তার ভাইকেই বেশি তোয়াজ করে। বাই দা বাই, ভানুটা এখনও আসছে না কেন? সবতাতেই যা ভাবায় না যে কী বলব।
নেদোমামা যেন এই সুযোগটাই খুঁজছিলেন। বলের লাইনে গিয়ে সপাটে কপিবুক কভার ড্রাইভ মারলেন। আপনি আর লোক পেলেন না জামাইবাবু, শেষ অবধি ভেনোটাকে চুজ করলেন।
আরে বাবা, অল শালাজ আর নট অ্যাট পার। আপনার শালা আর আমার শালা কি এক হল? চিজ অ্যান্ড চক? আপনার শালা নেদো সেন, রিটায়ার্ড এস. পি.।
আর শ্রীমান ভানু হল আমার শালা, অ্যা ডিগনিফায়েড ভ্যাগাবন্ড। ফোর টাইমস বি. এ. পার্ট ওয়ান রানার্স-আপ। কিশোর গল্প ক্রাইসিস
কথার মাঝখানে গুড্ডু এসে বলল, দাদু, দাদু, ইন্ডিয়া চার উইকেটে দুশো বত্রিশ।
—হাউ মেনি ওভারস?
—বিয়াল্লিশ। দ্রাবিড় একশো বাইশ, যুবরাজ সাতাশি।
গু-উ-ড। ব্রাভো। দেখুন জামাইবাবু, একেই বলে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট। রাহুল দ্রাবিড়। রকলাইক ডিফেন্স। সললিড। আর আপনি এই ক্রাইসিসের সময়ে ব্যাট করতে পাঠালেন অই নড়বড়ে ভেনোটাকে।
এখনো জিভের আড় ভাঙেনি, লোক দেখলে তোতলায়, ভালো করে কথা বলতে পারে না, ডাল আনতে বললে ডালডা আনে, সে কিনা ক্রাইসিস ম্যানেজ করবে। পুয়োর চ্যাপ। অ্যা ল্যাম্ব অন দা স্লটার।
কীর্তিশেখর খুব জোর দিয়ে কিছু বলতে পারলেন না। তবু সাহস করে বললেন— আহা নেদো, ওভাবে বলছ কেন? ও তো তোমার শালা। ওর দিদি শুনলে কী ভাববে বলো তো।
নেদোমামা আর একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন – অন্ধ স্নেহ ভালো নয় জামাইবাবু। ব্লাইন্ড ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনের বারোটা এই করেই বাজিয়েছিলেন। অপোনেন্ট টিমে যেখানে কৃষ্ণের মতো ডাকসাইটে অলরাউন্ডার সেখানে শকুনির মতো আধখানা বোলার নিয়ে টক্কর দেওয়া যায়?
দেখলেন তো কী রকম টেইল ইন কাউডাং হয়ে গেল। নিট রেজাল্ট কী.? আ বিগ জিরো। এখন দেখুন, দেয়ার ইজ নো ওয়ান টু গিভ ক্যান্ডেল ইন দি বাম্বু অফ দা কৌরবস। কৌরবদের বংশে বাতি দেওয়ার কেউ থাকল কি?
–না, না নেদো, তুমি কিচ্ছু ভেবো না। ভানু ঠিক নিয়ে আসবে। এই এল বলে। —আসবে, বাট ইউদাউট দি পান্ডুয়াজ অর আদার মিষ্টিজ। আপনার মনে নেই জামাইবাবু, সেবারে পিকনিকের দিন কৃষ্ণনগর থেকে সরপুরিয়া আর দই আনতে গিয়ে কেমন প্যান্ডিমোনিয়াম বাধিয়ে দিয়েছিল?
ওকে আমার জানা আছে। ওর ক্যালি ওর দিদির থেকে, মানে আমার সহধর্মিণীর থেকে সামান্য বেশি। বাট বোথ আর সেম— নাইনটিন আর টোয়েন্টি। কিশোর গল্প ক্রাইসিস
নেদোমামিমা হন্তদন্ত হয়ে দোতলার সিঁড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। থমকে দাঁড়ালেন। চশমাটা খুলে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে বললেন—থামো। বাজে বকবক কোরো না তো।
সব সময় মানুষের দোষ ধরা একটা স্বভাব। অই ছেলেটার জন্যেই সেদিন সরপুরিয়া খেতে পেরেছিলে। আর তোমার টাকার ব্যাগটা? সেটার কথা ভুলে যাচ্ছ? অকৃতজ্ঞ ।
নেদোমামা আনপারটাবড। কোনো বিকার নেই। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন—হিস্ট্রি। গিন্নি, সেসব আজ হিস্ট্রি। ফ্লুক। একদিন ঘটেছে বলে রোজ রোজ ঘটবে নাকি? তুমি প্লিজ, আমার ব্যাপারে ইনটারফিয়ার কোরো না। ভানুকে আমি তোমার চেয়ে ভালো চিনি।
নেদোমামিমা অগ্নিশর্মা। দু পর্দা গলা উঁচিয়ে বললেন—উঁ! আমার মায়ের পেটের ভাই, আর উনি নাকি আমার চেয়ে বেশি চেনেন। মরে যাই আর কী! জামাইবাবুকে মাটির মানুষ পেয়ে উলটো-পালটা বোঝাচ্ছে। আমার ভাইয়ের মতো ভাই হয় না।
নেদোমামা পালটা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। ভানু এসে পড়ায় ছেদ পড়ল। কীর্তিশেখর বললেন—নেদো, খাওয়ার ব্যবস্থাটা হাতে হাতে করে ফেল। তোমার লেফটেনান্টদের গাইড করো। তারপর পান্তুয়া রহস্যটা উদ্ধার কোরো।
খাওয়া দাওয়া পর লোকজন চলে যেতে বাড়ি একটু হালকা হল। রান্নার জায়গা থেকে অনবরত ছ্যাঁক-ছোঁক শব্দ আসছে। পাড়ার মাতব্বর ফুঁকে মুখুজ্জেকে নেদোমামা চেয়ার দিয়ে বসিয়ে দিয়েছেন রান্নার জায়গায়। কিশোর গল্প ক্রাইসিস
ঠাকুর হেল্পারদের বিশ্বাস নেই। হাত সাফাইয়ের ওস্তাদ। মাছের পিস, মশলাপাতি, আনাজ ইত্যাদি ত্রিপলের ফাঁক দিয়ে পাচার হয়ে যায়।
নেদোমামা বললেন, আচ্ছা জামাইবাবু, এত বড়ো বাড়ি, অগুনতি ঘর, আর পান্ডুয়া রাখলেন ছাগলের ঘরে। গন্ধেই তো বারোটা বাজবে।
কীর্তিশেখর এই প্রথম হোঃ হোঃ করে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে বললেন, কোনো এক সময় এই ঘরটায় ছাগল থাকত। এখন অনেক বছর থেকে আর ছাগল রাখা হয় না। এখন এটা ভাঁড়ার।
চাবি খুলুন তো দেখি। একটা প্রাইমারি ইনভেস্টিগেশন করা দরকার। দরকার পড়লে ফরেনসিক টিম ডেকে পাঠাব। ভুলে যাবেন না আমি একজন ডাকসাইটে পুলিশ অফিসার, হলামই বা রিটায়ার্ড।
সকলের চোখের সামনে দিনদুপুরে ইঁদুরে পান্ডুয়া খেয়ে গেল, আর আমি এ বাড়িতে থেকেও ধরতে পারলাম না, এটা কী করে হয়।
দিব্য তালা খুলে আলোটা জ্বালাতেই নেদোমামা ঢুকে পড়লেন ঘরের মধ্যে। এটাকে ঘর বললে অতিশয়োক্তি হয়। পুরোনো বাড়ির তিনভাঁজওলা সিঁড়ির নীচটা ঘিরে একটা পাঁচফুট বাই তিনফুট কুঠরি। জানলা নেই। কিশোর গল্প ক্রাইসিস
ছোট্ট একটা ঘুলঘুলি আছে, দেড়ফুট বাই দশ ইঞি। ঘুলঘুলিটার নীচে মেঝেতে দুটো পাশাপাশি টিনে পান্ডুয়া রাখা। টিনের অর্ধেকটা মাথা কেটে ভাঁজ করা। ওটাই টিনের মুখ বা প্রবেশপথ।
—স্যাম্পেল দেখান। এই দিব্য, হাঁ করে দেখছিস কী। কটা পান্ডুয়া তোল তো দেখি। নেদোমামা খুব ভালো করে পুলিশের চোখ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। পকেট থেকে ম্যাগনিফায়িং গ্লাস বের করে এখানে সেখানে ঠেকিয়ে দেখলেন।
রিটায়ার্ড হলে কী হবে, নেদোমামা এই গ্লাসটা আর একটা ছুরি সব সময় পকেটে রাখেন। খানিকক্ষণ দেখে বললেন—মনে হচ্ছে ছুঁচ জাতীয় কিছু একটা দিয়ে পান্ডুয়াগুলোকে ফুটো করা হয়েছে।
জামাইবাবু, এ বাড়িতে বা এ পাড়াতে আপনাদের শত্রু কেউ আছে যে আপনার নাতনির বিয়েতে ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে এরকম ঘৃণ্য কাজ করতে পারে?
কীর্তিশেখর দুদিকে ঘাড় নাড়লেন — কী যে বল! আমাদের কোনো শত্রু নেই। এ পাড়ায় সকলেই আমাদের খুব শ্রদ্ধাভক্তির চোখে দেখে।
নেদোমামা গম্ভীর হয়ে বললেন—মনে হচ্ছে স্যাবোটেজ। সাবধানে থাকুন। তা হ্যাঁরে দিব্য, বাড়ির কুঁচোকাঁচাগুলোকে দেখছি না কেন বলতো। গুড়ুকে দেখলাম একটু আগে।
কিন্তু জয়, রাজা, সোম, তুতুল, মিতুল, রনি, টিপ ওরা কোথায় গেল? ডাক তো ওদের। কীর্তিশেখর বললেন ওদের আবার এর মধ্যে জড়াচ্ছ কেন? ওরা এসবের কী জানে ?
—আচ্ছা জামাইবাবু, ঘুলঘুলির ওদিকটায় কী আছে? খিড়কিতে যাওয়ার গলিপথটা বোধ হয়? একবার পেছনে গিয়ে জায়গাটা দেখা দরকার। কিশোর গল্প ক্রাইসিস
তুমি আবার তোমার পুলিশি কায়দায় তদন্ত শুরু করছ। দেখছ ঘুলঘুলিটার মধ্যে দিয়ে বেড়াল গলার জায়গা নেই। তা ছাড়া গলির দিকে ওটা মাটির থেকে কম করে সাত-আট ফুট উঁচুতে। কারোর পক্ষেই ওখান দিয়ে ঢোকা দূরের কথা, মাথা গলানোও সম্ভব নয়।
—নাথিং ক্যান বি রুলড আউট জামাইবাবু। তদন্তের খুঁত রাখতে নেই। —ঠিক আছে। চাইছ যখন, গলিটা দেখে এসো।
মিনিট পাঁচেক ধরে গলিটা ভালো করে দেখলেন নেদোমামা। একটা টুল চেয়ে নিয়ে ঘুলঘুলিটার মধ্যে মাথা গলাবার চেষ্টা করলেন। পারলেন না। উলটে গুঁতো খেলেন।
কীর্তিশেখর বললেন
—যা হয়েছে হয়েছে, ছেড়ে দাও। ইঁদুরেই খেয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। ও গুলোকে বাইরে ফেলে দেওয়ার ব্যবস্থা করো বরং।
নেদোমামা চিন্তিতমুখে বসার ঘরের সোফায় বসে আছেন। এক এক করে বাড়ির কুচোবাচ্চারা নেদোমামার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। যেন টি. আই. প্যারেড হবে।
—লাইন করে দাঁড়িয়ে পড়ো। উঁহু উঁহু, ওভাবে নয়। বড়ো থেকে ছোটো। ফল-ইন করো। দাঁড়িয়েছ? গু-উড। সবাই এসেছে? কই, রনি আর রাজা কোথায় গেল? ওদের দেখছি না কেন?
টিপ স্মার্টলি জবাব দিল
—কী জানি দাদু। অনেকক্ষণ থেকে ওদের দুজনকে দেখছি না। কোথায় গেছে কে জানে।
নেদোমামিমা বাচ্চাগুলোকে ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন—বলি তোমার কি বুড়ো বয়সে ভিমরতি ধরল? ওদেরকে খুনের আসামি পেয়েছ নাকি? রিটায়ার করেও পুলিশি দাদাগিরি গেল না।
নেদোমামা মুখ না তুলেই বললেন—স্টপ প্লিজ, ম্যাডাম। দ্যাটস মাই বিজনেস, নান অফ ইয়োরস। দিজ ইজ নট দা রাইট টাইম ফর এনি ন্যাকামি অর আদিখ্যেতা।
নেদোমামিমা গজগজ করতে করতে ওপরে উঠে গেলেন। রনি আর রাজা হঠাৎ কোত্থেকে এসে বলল–দাদু, ভারত না জিতছে। আর দুটো উইকেট ফেলতে পারলেই হল। চল্লিশ বলে নব্বই রান করতে হবে পাকিস্তানকে। পারবে না বলো। কিশোর গল্প ক্রাইসিস
–কোথায় ছিলে এতক্ষণ ?
নেদোমামার পিলে চমকানো কণ্ঠস্বরে রাজা-রনির আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার যোগাড়। ভয়ে ভয়ে বলল, আমরা খেলা দেখছিলাম।
—লাইনে দাঁড়াও। কুইক। দাঁড়িয়েছ? বেশ এবারে বলো তো আজ সকালে বাড়িতে
কী জলখাবার হয়েছিল ?
একসঙ্গে অনেকগুলো গলার আওয়াজ—লুচি আলুরদম আর বোঁদে। —সবাই খেয়েছ?
-হ্যাঁ-অ্যাঁ।
—কে কে খাওনি? সত্যি বলবে। লুকোবে না। মিথ্যে বললে পুলিশে দেওয়া হবে। কারোর মুখে কথা নেই। এ ওর মুখে চাওয়াচাওয়ি করছে।
নেদোমামাকে ঘিরে বেশ ভিড় জমে গেছে। যেন জজসাহেবের এজলাস। —কে কে সকালে জলখাবার খাওনি? রেইজ ইয়োর হ্যান্ড। রাইট হ্যান্ড। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার ?
আস্তে আস্তে দুটো হাত উঠে এল—রনি আর রাজার।
নেদোমামা উঠে দাঁড়ালেন। রাজা-রনির সামনে এসে বললেন— ডোন্ট গেট নার্ভাস। আমি তোমাদের কেন জলখাবার খাওনি জিজ্ঞেস করব না।
নিশ্চয় তোমাদের খিদে ছিল না। কিন্তু তোমাদের কয়েকটা ধাঁধা, না ঠিক ধাঁধা নয়, জি. কে. ধরব। ঠিক ঠিক উত্তর দেবে ।
কীর্তিশেখর এতক্ষণ সব দেখছিলেন আর মজা উপভোগ করছিলেন। নেদোমামার কাছে গিয়ে বললেন—ওদের ছেড়ে দাও। বিয়ে বাড়ি বলে কথা। সাজগোজ করবে, আনন্দ করবে। পান্তুয়া ইঁদুরে খেয়েছে তাতে ওরা কী করবে?
—জাস্ট আ মিনিট, জামাইবাবু। রাজা, হোয়াট ইজ দা রিলেশন বিটুইন আ পাটকাঠি অ্যান্ড আ ঝাঁটার কাঠি? আর রনি, তুমি বলো বল্লমের ফাংশান কী। সেভেনে পড়। নিশ্চয় পারবে।
দুজনেই চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল—আর করব না দাদু, অন্যায় হয়ে গেছে। বুঝতে পারিনি। আমরা চারটের বেশি খাইনি ।
নেদোমামা উচ্চৈঃস্বরে হাসতে হাসতে বললেন—জামাইবাবু, ইনভেস্টিগেশন ইজ ওভার। এই নিন আপনার আসামি।
তবে কেস দেবেন না। জুভেনাইল কোর্টে পাঠাবার দরকার নেই। অপরাধ কবুল করেছে বলে এবারের মতো মাফ করে দিন।
—কিন্তু তুমি বার করলে কীভাবে?
নেদোমামার মুখে চওড়া হাসি। গোঁফের ডগাটা পাকিয়ে নিয়ে বললেন— অবজারভেশান। এই দেখুন, এটা একটা পাটকাঠি। চারফুট লম্বা। অ্যান্ড দিস ইজ আ ঝাঁটার কাঠি কালেকটেড ফ্রম আ মুড়োঝাঁটা। এক ফুট লেংথ।
এইবার ঝাঁটার কাঠিটা পাটকাঠির মুখে ঢুকিয়ে দিলে কী পাচ্ছি? চার ফুট দশ ইঞ্চি লম্বা একটা বল্লম। ঘুলঘুলির একজনের কাঁধে দাঁড়িয়ে আর একজন যদি বল্লমটা আন্দাজে পান্ডুয়ার টিনের মধ্যে গিঁথিয়ে দেয় তাহলে দুটো একটা পান্ডুয়া উঠে আসতে পারে। Kishor Golpo Crisis
তবে যেহেতু ঝাঁটার কাঠি, অর্থাৎ বল্লমের মাথাটা বাঁকানো নয় সেহেতু বেশিরভাগ পান্ডুয়াই বিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও আটকে থাকেনি। পিছলে পড়ে গেছে। এই হল আপনার ইঁদুরে খাওয়ার রহস্য।
যা হোক, শুভ দিনে ওদের আর বকাবকি করবেন না। না বুঝে না জেনে করে ফেলেছে। যা যা, তোরা সাজুগুজু করে নে। আর একটা কথা জামাইবাবু, ‘সুইটস ইন্ডিয়া'র হাজার পিস ফ্রেশ পান্ডুয়ার বিলটা কিন্তু আমিই পেমেন্ট করব। Kishor Golpo Crisis
প্লিজ, না করবেন না। আরে! ওই তো। আপনার ফ্রেশ পান্তুয়ার কনসাইনমেন্ট এসে গেছে। দেখি দেখি। পঞ্চাশ পিস ফর টেস্টিংটা কোথায়?
জামাইবাবু, রাজা রনি আর ভানুকে দুটো করে এক্সট্রা দেবেন। ওরাই তো আসল ক্রাইসিসটা ম্যানেজ করল, কী বলেন? Kishor Golpo Crisis, Kishor Golpo Crisis, Kishor Golpo Crisis, Kishor Golpo Crisis
নিত্য নতুন সকল আপডেটের জন্য জয়েন করুন
If any objections to our content, please email us directly: helptrick24bd@gmail.com