আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণগুলো কি? এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফলাফল
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। ছয় দফা দাবি বাঙালির মুক্তির সনদ। ছয় দফা দাবির পক্ষে বাঙালি গণআন্দোলন গড়ে তোলে। বাঙালির আন্দোলনে পাকিস্তান সরকার ভীত হয়ে পড়ে।
আওয়ামী লীগ নেতাদের বি ক. তানি শাসকেরা ষড়যন্ত্র করে মামলা করে, যা ইতিহাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বিভিন্ন কারণে হয়েছিল।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণ :
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু বাঙালি মুক্তির সনদ ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। ছয় দফা দাবি যখন চরম সফল হয়েছিল, তখন আইয়ুব খান বাঙালিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন। নিম্নে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণ উল্লেখ করা হলো :
১. বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা ধ্বংস :
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উদ্ভব হয়। ১৯৬৬ সালের ছয় দফার সাহায্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা আরো দৃঢ় হয়। বাঙালি চেতনায় ভীত হয়ে আইয়ুব খান সরকার বাঙালি নেতাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন। সেই ষড়যন্ত্র মামলা হলো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা।
২. ছয় দফা আন্দোলন দমন :
ছয় দফা আন্দোলন বাঙালির মুক্তির সনদ। ছয়দফা আন্দোলনের ফলে বাঙালি জাতি একত্রিত হয়ে পাকিস্তানি সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন।
ছয় দফা আন্দোলন দমন করার জন্য আইয়ুব খান এই ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুরকে প্রধান করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
৩. শেখ মুজিবকে উৎখাত :
পূর্ববাংলার রাজনীতিতে শেখ মুজিবর একজন জনিপ্রয় নেতা। দিন দিন শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আইয়ুব খান এই জনপ্রিয়তা মেনে নেননি। শেখ মুজিবুর আওয়ামী লীগের একজন অন্যতম নেতা ছিলেন। শেখ মুজিবুরকে রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করার জন্য আইয়ুব খান তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করেন।
৪. শাসন ক্ষমতা ধরে রাখতে :
পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব খান শাসন ক্ষমতা ধরে রাখতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করেন। পূর্ব পাকিস্তানের নেতারা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন ও জনমত গড়ে তুলেছিলেন। আইয়ুব সরকার উপলব্ধি করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে আওয়ামী লীগ নেতাদের উৎখাত করতে হবে।
৫. রাজস্ব আদায় অব্যাহত :
পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রচুর রাজস্ব আদায় করত। এই রাজস্ব পশ্চিম পাকিস্ত ানের উন্নয়নে ব্যয় করা হতো। পাকিস্তান নেতারা চিন্তা করে পূর্ব পাকিস্তান তাদের হাতছাড়া হলে তারা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে রাজস্ব আদায় অব্যাহত রাখার জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করেন।
৬. সেনাবাহিনীর সমর্থন আদায় :
পাকিস্তান সরকার সেনাবাহিনীর সমর্থন আদায় করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি লোকদের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করেন। আইয়ুব খানের অন্যতম লক্ষ্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর নিকট আসামিদের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে উপস্থাপন করা।
৭. পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ রক্ষা :
পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কঠোর আন্দোলনে আইয়ুব খান ভীত হন। তিনি মনে করেন পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ রক্ষা করতে হলে পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের দমন করতে হবে। এছাড়া পাকিস্ত তানিদের প্রভাব রক্ষা করা যাবে না।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে পাকিস্তানি সরকার বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য নেতাদের দমন করার জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করেন। আইয়ুব খান সরকার বাঙালি জাতিকে দমিয়ে রাখতে এই মামলা করেন।
ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি যখন ব্যাপক রূপ ধারণ করে, তখন আইয়ুব খান এই ষড়যন্ত্র মামলা করেন। পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃত্বশূন্য করে ক্ষমতা দখলের জন্য আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মালা করেন।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফলাফল
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি ঘৃণ্য, প্রতিহিংসা মূলক, দমনপীড়নমূলক মামলা। বাঙালি নেতাদের দমিয়ে রাখার জন্য আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করেন। মূল মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে এক নম্বর আসামি করা হয়।
আইয়ুব সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করে। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাঙালিদের দমিয়ে রাখা।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফলাফল ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফলাফল ছিল সুদূপ্রসারী। নিম্নে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফলাফল উল্লেখ করা হলো :
১. কঠোর আন্দোলন :
ছয় দফা আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সাহস জুগিয়েছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সেই আন্দোলনে প্রাণ আন্দোলনের রূপদান করেন। ফলে বাঙালি জাতি যেকোন মূল্যে পাকিস্তানিদের পূর্ব পাকিস্তান থেকে উৎখাত করায় প্রতিজ্ঞা নেন।
২. জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি :
আগরতলা মামলা বাঙালি জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি করেন। বাঙালিরা স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার চেতনার অনুপ্রাণিত হয়।
তাদের মধ্যে পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস উদয় হয়। বাঙালিরা পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থা উৎখাত করার জন্য দৃঢ় মনোবল গঠন করেন।
৩. আইয়ুববিরোধী আন্দোলন :
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানিদের মধ্যে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন উদ্ভব হয়। আইয়ুব সরকারকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে উৎখাত করার জন্য গণআন্দোলনের সৃষ্টি। পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের জনগণ আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে লিপ্ত হন।
৪. ১১ দফা কর্মসূচি গ্রহণ :
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রতিহত করার জন্য ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করেন। এই কর্মসূচি পাকিস্তানি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে সাহস যোগায়। পাকিস্তানিদের পূর্ব পাকিস্তান হতে বিতাড়িত করার জন্য ১১ দফা কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৫. আইয়ুব খানের পতন :
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের পাকিস্তানি সরকার বন্দি করেন। এতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলেন।
এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা চক্রান্ত করে আগরতলা মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে হত্যা করে। এর ফলে পূর্ব বাংলার জনগণ আন্দোলন করেন। গণআন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন।
৬. শেষ মুজিবের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি :
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় প্রধান আসামি শেখ মুজিবুর রহমান। এই প্রেক্ষিতে দেশি-বিদেশি পত্রিকায় শেখ মুজিবের পরিচয় তুলে ধরা হয়। শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা দেশের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে।
৭. মুক্তিলাভ :
তীব্র আন্দোলনের চাপে পাকিস্তানি সরকার শেখ মুজিবুরসহ সকল আসামিদের মুক্তি দেয়। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হয়।
শেখ মুজিব দেশে আসলে জনতা তাকে বরণ করে নেয়। ১৯৬৯ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়া হয়।
পরিশেষে বলা যায় যে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরসহ অন্যান্য আসামিদের বন্দি করা হয়। এর ফলে বাংলার দামাল ছেলেরা কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলে।
পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কঠোর আন্দোলনের মুখে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হয় ।
নিত্য নতুন সকল আপডেটের জন্য জয়েন করুন
If any objections to our content, please email us directly: helptrick24bd@gmail.com