প্রশ্ন ॥ ইমাম আল গাজ্জালির মতে একজন যোগ্য শাসকের গুণাবলি আলোচনা কর। Qualities of a good ruler according to Imam al-Ghazali
উত্তর: ভূমিকা : দার্শনিক, রাজনীতিক, ধর্মতাত্ত্বিক ও ইসলামি চিন্তাবিদ ইমাম আল গাজ্জালি সত্যবাণী ও প্রজ্ঞার প্রবল শক্তি নিয়ে মধ্যযুগে আবির্ভূত হন। তিনি তৎকালীন সময়ে ইসলামকে সকল জাহেলী অনৈসলামিক চিন্তাধারার প্রভাব থেকে মুক্ত করে কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে করেন। তার চিন্তাচেতনা বা ইসলামি দর্শনের অন্যতম দিক হলো আদর্শ বা যোগ্য শাসকের গুণাবলি প্রসঙ্গে নির্দেশনা। তিনি তার 'তীশরুল সজরুল' গ্রন্থে যোগ্য শাসকের কতিপয় গুণাবলি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
ইমাম আল গাজ্জালির মতো একজন যোগ্য শাসকের গুণাবলি :
নিম্নে ইমাম আল গাজ্জালির মতে যোগ্য শাসকের গুণাবলি আলোচনা করা হলো :
১. মেধা/বুদ্ধিমত্তা : রাষ্ট্রীয় যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন। আল গাজ্জালির মতে, শাসককে অবশ্যই মেধা ও প্রখর বুদ্ধিমত্তার অধিকারী হতে হবে। মেধাবী শাসক সহজেই যেকোনো কৌশল অবলম্বন করতে পারে। অধ্যয়ন, অনুশীলন, প্রশিক্ষণ ও কর্ম অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বুদ্ধিমত্তার অধিকারী হওয়া যায় ।
২. ধার্মিকতা : ইমাম আল গাজ্জালির মতে, একজন শাসককে ধার্মিক হতে হবে। কারণ পার্থিব জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ক্ষণস্থায়ী এবং তা মৃত্যুর সাথে সাথে শেষ হয়ে যাবে। আর আখেরাতের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য চিরস্থায়ী। তাই ইহলৌকিক সুখের সাথে সাথে পারলৌকিক সুখের তালাশ করতে হবে। আর এ ব্যাপারে শাসক ও শাসিতের উচিত আল্লাহর হুকুম যথাযথভাবে পালন করা।
৩. ধৈর্য : অস্থির চিত্তের শাসকের পক্ষে দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তাই একজন শাসককে সাফল্য অর্জন করতে হলে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। ধৈর্যের সাথে মনোযোগসহকারে ও একাগ্রতার সাথে কোনো কাজ সম্পাদন করা একজন যোগ্য শাসকের অন্যতম গুণ ।
৪. ন্যায়পরায়ণতা : আল গাজ্জালির মতে, একজন যোগ্য শাসককে ন্যায়পরায়ণতা ও গণতান্ত্রিক নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। কেননা আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান এবং বেআইনীভাবে কাউকে শাস্তি দেয়া যাবে না। শাসনকার্য পরিচালনার সময় শাসক স্বজনপ্রীতি বা অন্য কোনোকিছু দ্বারা প্রভাবিত হবেন না বা অন্যায়ের আশ্রয় গ্রহণ করবেন না ।
৫. বাগ্মিতা : একজন যোগ্য শাসকের জন্য বাগ্মিতা একটি বিশেষ গুণ। শাসনকার্য পরিচালনার সময় শাসককে বাকপটু হতে হবে। বাকপটুতার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনা ও কর্মসূচিসমূহের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে হয়। আল গাজ্জালির মতে, একজন যোগ্য শাসকের বাগ্মিতার গুণ অবশ্যই থাকতে হবে।
৬. দূরদৃষ্টি : একজন প্রকৃত শাসককে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হবে। কেননা রাষ্ট্র শুধুমাত্র বর্তমান অবস্থা নিয়ে আবর্তিত নয়, বরং অতীত ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আবর্তিত হয়। যে কারণে অতীতে কী ঘটেছিল, বর্তমানে কি ঘটছে এবং ভবিষ্যতে কি ঘটবে তার একটি স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে শাসককে শাসনকার্য পরিচালনা করতে হয়।
৭. গণতন্ত্রের প্রতি সহনশীলতা : আল গাজ্জালির সময়ে গণতন্ত্রের কোনো ব্যবস্থা না থাকলেও তিনি গণতন্ত্রের কথা বলে গেছেন। তিনি যেকোনো রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জনমতকে বিবেচনা করতে বলেছেন।
৮. উদারনৈতিকতা : ইমাম আল গাজ্জালির মতে, শাসককে ইসলামি আইন অনুযায়ী সমাজে সকলের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধ নিশ্চিত করতে হবে। একজন শাসককে কঠোরতার পরিবর্তে উদারতার আশ্রয় নিতে হবে। জনগণের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের কথা চিন্তা করে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।
৯. জনকল্যাণ সাধন : আল গাজ্জালির মতে, একজন যোগ্য শাসক সবসময় জনকল্যাণের জন্য কাজ করবেন। জনকল্যাণ সাধন জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং জনগণের সার্বিক সহযোগিতার জন্য একজন আদর্শ শাসক সর্বদা তৎপর থাকবেন।
১০. অহংকার বর্জন করা : ইমাম গাজ্জালি মনে করেন, প্রকৃত শাসক অবশ্যই অহংকার বর্জন করে শাসনকার্য পরিচালনা করবে কারণ অহংকার পতনের মূল । অহংকারের মাধ্যমেই ক্রোধের প্রকাশ হয়। তাছাড়া অহংকারের দ্বারা প্রতিশোধ গ্রহণের স্পৃহা জাগ্রত হয়।
১১. অন্যান্য গুণাবলি : এছাড়াও ইমাম গাজ্জালি একজন যোগ্য শাসককে বিলাসিতা বর্জন, নম্র-ভদ্র ব্যবহার, নির্ভয়ী ও সাহসী, ইবাদত গোজার, সততা, মদপাদন ত্যাগী, জুয়াখেলা ত্যাগী প্রভৃতি গুণের অধিকারী হওয়ার কথা বলেছেন ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ইমাম আল গাজ্জালির সেই মধ্যযুগের এগারো শতকে একজন যোগ্য শাসকের গুণাবলি সম্পর্কে যে উপদেশ দিয়েছিলেন বর্তমান বিশ্বের যেকোনো দেশের জন্য উহা প্রযোজ্য। বর্তমান বিশ্বের সকল সমাজে তার নির্দেশিত গুণাবলি সুখ্যাতি অর্জন করেছে। যদি কোনো শাসক উক্ত গুণাবলি অনুসরণ করে তবে সে আদর্শ শাসক হিসেবে স্বীকৃত হবে।
নিত্য নতুন সকল আপডেটের জন্য জয়েন করুন
If any objections to our content, please email us directly: helptrick24bd@gmail.com