কিশোর গল্প : ধার থাকা ভালো নয় | Kishor Golpo : Dhar thaka Valo noi
মাসখানেক ধরে শ্রীমত্ত দারোগার সময়টা ভালো যাচ্ছে না। কাজেকর্মে আর আগের মতো মন বসছে না। সবসময়েই একটা অনীহা, এক ধরনের নিরুৎসাহতা গ্রাস করেছে তাঁকে।
যে মানুষ চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আঠারো ঘণ্টা কাজের মধ্যে থাকতে ভালোবাসতেন, অলসতা দেখলে যাঁর ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠত, তাঁর এ হেন উদ্যমহীনতা দেখে শুধু পরিবারের লোকজন কেন, অফিসে পাড়ায় দোকান-বাজারে সবাই বেশ ভাবিত।
অথচ একমাস আগেও কেমন চনমনে টাট্টুঘোড়ার মতো টগবগ করে দাপিয়ে বেড়াতেন। তাঁর দাপটে চোর-গুন্ডা-বদমাশদের রুজি-রোজগার বন্ধ হবার জোগাড়।
রাত দুটোতে খবর এল বিষ্টু কর্মকারের জুয়েলারির দোকানের সাটার ভেঙে সর্বস্ব চুরি হয়ে গেছে, ছুটলেন সেখানে। পাজামার ওপর ইউনিফর্ম চাপিয়ে পকেটে রিভলবার নিয়ে সটান বাগদিপাড়ায় পদামস্তানের ডেরায়। ধার থাকা ভালো নয়
চুলের মুঠি ধরে পদাকে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে টেনে নিয়ে এসে আছড়ে ফেললেন বিষ্টুর পায়ের কাছে। সঙ্গে লুঙ্গিতে বাঁধা গুচ্ছের বন্ধকি গয়নার তাল। বিষ্টু গদগদ হয়ে শ্রীমন্ত দারোগার পায়ের ধুলো নিয়ে জিভে ঠেকাল তিনবার।
টাকাপয়সা নেওয়া তো দূরে থাক পরদিন সকালে বিষ্টু যখন সস্ত্রীক এসে জলু ময়রার দোকানের ক্ষীর মেশানো পঞ্চাশটা নিখুঁতি, এক বস্তা বাসমতী চাল, কেজি পাঁচেক নলেন পাটালি,
আর নতুন একটা ফরাসডাঙার নরুনপাড় ধুতি বেতের টুকরিতে করে এনে শ্রীমত্ত দারোগার ইজি চেয়ারের পাশে রাখল, তখন তাঁর অগ্নিশর্মা চেহারা দেখে বিষ্টুর কাছা-কোঁচা এককাট্টা হবার জোগাড়।
এমনকি বিষ্টুর বউ মিনতিও একগলা ঘোমটার আড়াল থেকে ডালডামাখানো পেছল গলায় বলল
— “কাকাবাবু, কাল হবিবপুরে গিয়েছিলাম বাপের বাড়ি। মা কিছু সজনের ডাঁটা আর চালকুমড়ো দেওয়া বিউলি ডালের বড়ি দিয়েছিল। তা আপনি ভালোবাসেন বলে ক’খান নিয়ে এলাম আপনার জন্যে।”
শ্রীমন্ত দারোগা কাগজ থেকে মুখ না তুলেই বললেন — “নিয়ে যাও। ওসবে আমার কোনো প্রয়োজন নেই। পরিশ্রম, নিষ্ঠা, অধ্যবসায় এগুলোই আসল বুঝলে বিষ্টু। শুধু সোনা চিনলে হবে? পদার মতো লোকদেরও তো চিনতে হবে।” ধার থাকা ভালো নয়
শুধু কী বিষ্টু কর্মকার। কাসুন্দির হাটে সার্কাস হচ্ছিল—নিউ ভগবতী সার্কাস— শ্রীমন্ত দারোগার কানে এল সার্কাস থেকে একটা মাঝারি সাইজের বাঘ ট্রেনারের হাত ছিটকে পালিয়েছে।
ব্যস! শ্রীমন্ত দারোগা টেকো হালদারের বড়ো খ্যাপলা জাল আর দু'খানা কোঁচ নিয়ে বসে রইলেন দেবেন পাড়ুইদের বাগানটা যেখানে নদীর সঙ্গে মিশেছে সেখানে।
রাত্তির আড়াইটের সময় থানার জিপে চেপে একলা বগলদাবা করে সেই বাঘকে পৌঁছে দিয়ে এলেন সার্কাসের তাঁবুতে। সার্কাসের মালিক দামোদর নায়েক একটা হাজার টাকার নোট খামে ভরে অনেকক্ষণ ধরে পকেটে গুঁজে দেবার চেষ্টা করল, কিন্তু শ্রীমন্তর তাগড়া গোঁফের দিকে তাকাতেই নিজেকে সামলে নেয়। ধার থাকা ভালো নয়
এই হল শ্রীমন্ত দারোগা। অপরিসীম সাহস, সুঠাম মজবুত চেহারা। সততা ও নিষ্ঠার কোনো তুলনাই হয় না। সর্বদা যেন উনুনে চাপানো জলের গামলা। টগবগ টগবগ করে ফুটছে। দশবছর হল দারোগাগিরি করছেন।
গত পাঁচবছর ধরে আড়াইসিকি গ্রামের থানার চার্জে থাকার পর দু'মাস হল এই ডুমুচ্ছে গ্রামে বদলি হয়ে এসেছেন। আড়াইসিকি থানা ছেড়ে আসার একটুও ইচ্ছে ছিল না ওঁর। ধার থাকা ভালো নয়
কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে ওপরওয়ালারা নাকি ওঁর কাজে-কর্মে সন্তুষ্ট নয়। শ্রীমন্ত দারোগা অবশ্য মুখে কিছু প্রকাশ করেননি। এমনকি ওঁর স্ত্রীর কাছেও নয়।
শুধু ওঁর খাস আর্দালি শিবসদাগর একদিন প্রাণকেষ্টর দোকানে চা খেতে খেতে গল্প করছিল যে শ্রীমন্ত দারোগার নামে ওপর থেকে চিঠি এসেছে যে ওঁর সততায় কর্তৃপক্ষ ভীষণ বিরক্ত।
এছাড়া গত চার বছর ছ'মাসে আড়াইসিকি গ্রামে একটাও ক্রাইম হয়নি, এমনকি ছাগল হারানো বা সাইকেলে মুরগি চাপা দেওয়ার ঘটনাও নয়। উনি আসার প্রথম ছ'মাসেই যা বিষ্টু কামারের দোকানে চুরি কিংবা সার্কাসের বাঘ পালানোর ঘটনা, বা দুর্ঘটনা যাই বলুন, ঘটেছিল। ধার থাকা ভালো নয়
তার পর থেকে তো কাক আর প্যাঁচা একসঙ্গে এক মালসা থেকে জল খায়। বিষ্টু কর্মকার তো রাতে দোকানের সাটারও নামায় না। শুধু কোলাপসিবল গেটটা টেনে রাখে। তালা- ফালাও দেয় না।
গদাধর মোহান্তির বউ তো আবার সমস্ত গয়না-ফয়না, আংটি-ঘড়ি সব বাসরাস্তায়, যেখানে ধান শুকোতে দেওয়া হয়, সেখানে শুকোতে দেয়। মোট কথা গ্রামে আর চোর-ডাকাত-গুন্ডা-বদমাশ বলতে কেউ নেই। পদামস্তান এখন দিনরাত ছিন্নমস্তার মন্দিরে পুজো-আচ্চার জোগান দেয়।
এতে অবশ্য লাভ হয়েছে পাশের থানার দারোগা হরিনিবাস কাঁড়ারের। একবছরের মধ্যে কর্তৃপক্ষের নজরে পড়ে গেছেন। গাঁয়ে রোজ একটা করে চুরি-ডাকাতি খুনখারাপির ঘটনা লেগেই আছে। হরিনিবাসের কত সুনাম বেড়ে গেছে। ধার থাকা ভালো নয়
চারতলা বাড়ি হাঁকিয়েছেন। হরিনিবাস বাজারে গেলে মাছের দাম বেড়ে যায়। শ্রীমন্ত দারোগার অবশ্য এদিকে কোনো আকর্ষণ নেই। শুধু আপত্তি ছিল এই ডুমুচ্ছে গ্রামে পোস্টিং পাওয়া নিয়ে। গ্রামের নামটা শুনেই পিত্তি চটকে গিয়েছিল।
কবে কোন্কালে একটা ডুমুরগাছ আর একটা ছাতিমগাছ পাশাপাশি ছিল জমিদার ভক্তিভূষণ পালচৌধুরীর বাগানে। তার থেকে গ্রামটার নাম হয়েছিল ডুমুরছাতিম। লোকের মুখেমুখে কালেকালে সেটা ডুমুচ্ছে হয়ে গেছে।
তবু যাই হোক মানিয়ে নিয়েছিলেন শ্রীমন্ত দারোগা। রাতবিরেতে একা একা ঘুরে বেড়াতেন। কখনো জিপে চেপে, কখনো ঘোড়ার পিঠে, কখনো আবার হেঁটে হেঁটে। কাউকে ভয় পেতেন না। এক মাসের মধ্যে কেমন পালটে গেলেন।
সব সময় তাঁর মনে হচ্ছে কেউ যেন তাঁকে ফলো করছে। ঘটনার সূত্রপাত এক সকালে। ভোর পাঁচটায় তাঁর হাঁটতে বেরোনোর অভ্যেস। ফুটিফুটি আলো। দূরের জিনিস ভালো দেখা যায় না। আবছা আবছা। ছায়া ছায়া।
সে দিনটা ছিল মঙ্গলবার। আগের দিন ফিরেছেন বেশি রাতে। টেকো হালদারের বাগানে নাকি রোজ মাঝরাতে গানবাজনার শব্দ শোনা যায় বলে টেকো থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিল। ওই রাতেই নাকি শ্রীমন্তর ঘাড়ে ভূতেরা সুড়সুড়ি দিয়েছিল।
সবই অবশ্য সবজান্তা নিষ্কর্মা বাউন্ডুলে শিবেন বোসের রটনা। আসল কারণটা শ্রীমত্ত দারোগা কাউকে বলেননি। নিজের বউকেও নয়। ভোর পাঁচটার সময় শ্রীমন্ত দারোগা বেরোলেন। হাফপ্যান্ট, টি-শার্ট, পায়ে কেড্স, মাথায় টুপি। ধার থাকা ভালো নয়
রাস্তার কুকুর তাড়ানোর জন্য একটা লাঠি। গেটে তালা লাগিয়ে চাবিটা বারান্দায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গটগট করে সামনের মোড় অবধি এলেন। অন্যদিন না দাঁড়িয়ে সটান বাঁদিকে ঘুরে মিশনমাঠের দিকের পথটা ধরেন। আজ থমকে দাঁড়ালেন।
দ্বাদশ মন্দিরের রকে কেউ একজন বসেছিল। দূর থেকে ভালো দেখা যাচ্ছিল না। তবু শ্রীমন্ত দারোগার অভিজ্ঞ চোখ খুব ভালো নজরে দেখল না তাকে। বয়স তিরিশের নীচে। গালে চাপ দাড়ি।
পরনে ফুলপ্যান্ট আর ফুলছাপ দেওয়া হাওয়াই শার্ট। দারোগাবাবু বুঝতে পারলেন লোকটা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। খানিক ভেবে নিয়ে মন্দিরের দিকে এগোলেন। লোকটা চকিতে উঠে হাঁটতে শুরু করল ডান দিকের রাস্তা ধরে। ধার থাকা ভালো নয়
শ্রীমন্ত হাঁটার গতি বাড়ালেন যদি মোড়টায় পৌঁছে লোকটাকে দেখা যায়। মন্দিরের কাছে পৌঁছতেই লোকটা চোখের নিমেষে দীপক বিষ্ণুদের পাশের গলিটার মধ্যে ঢুকে গেল। শ্রীমন্ত দারোগা হাতের লাঠিটা ঘোরাতে ঘোরাতে মিশনমাঠের দিকে হাঁটা লাগালেন।
মাঠের সীমানার দেয়ালে একটা বড়ো লোহার গেট। সবসময় বন্ধ থাকলেও মানুষ ঢোকার জন্য একটা ছোটো গেটও আছে। মাথা নীচু করে ঢুকতে হয়। মাঠে ঢুকতেই তাঁর চোখ ছানাবড়া।
অনেকটা দূরে শিরীষ গাছটার নীচে লোকটাকে দেখতে পেলেন। দারোগাবাবু ভাবলেন একটা পাক দিয়ে ওদিকে যাওয়ার সময় লোকটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। মুখটা ঘোরাতেই লোকটা হাপিস।
এরপরে লোকটাকে প্রায়ই দেখতে পাচ্ছিলেন। কখনো সামনে, কখনো পেছনে। বাজারে গিয়ে নীচু হয়ে টমেটো বাছছেন, লোকটা আলুর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে। ডিউটিতে যাচ্ছেন, লোকটা। ঘোড়ায় চেপে হুমনিপোতা ব্লক অফিসে যাচ্ছেন, সামনে হেঁটে যাচ্ছে লোকটা।
এমনকি হারান সাধুখাঁর মেয়ের বিয়েতে নেমন্তন্ন খেতে গেছেন, সেকেন্ড ব্যাচ, বরযাত্রীদের ব্যাচেই বসেছেন, খাতির বেশি পাওয়ার জন্য। সবে একটা মটন কাটলেট শেষ করে দ্বিতীয়টায় কামড় দিয়েছেন, থার্ড-রো তে দেখতে পেলেন লোকটাকে। ধার থাকা ভালো নয়
চাপদাড়ি। প্যান্টের ওপরে ফুলছাপ হাওয়াই শার্ট। শ্রীমন্ত দারোগা যতবার তাকালেন ততবার দেখলেন লোকটা ওঁর দিকেই তাকিয়ে। এমনকি ইচ্ছে করে অন্যদিকে মুখ করে চোখের মণি ট্যারা করে দেখলেন। কোনো পরিবর্তন নেই। লোকটা তাঁকেই গিলছে। দারোগাবাবু খুব ভাবিত হলেন।
এভাবে চার-পাঁচদিন কাটল। দারোগাবাবু ভেতরে ভেতরে খুব চিন্তিত হলেন। খুন- টুন হয়ে যাবেন না তো! একবার ভাবলেন এটা আড়াইসিকি থানার দারোগা হরিনিবাসের কোনো চাল নয় তো! ডুমুচ্ছেতে কোনো অশান্তি নেই বলে ভাবটা এমন—'দাও পাঠিয়ে শ্রীমন্ত দারোগার ঘাড়ে। বুঝুক ঠেলা।
মোট কথা খুবই চিন্তার মধ্যে আছেন। সাতদিনের মধ্যে ভুঁড়ি দু-এক ইঞ্চি কমে গেছে।' বেল্টে দুখানা ফুটো বাড়াতে হয়েছে। কোনো কাজেই আর আগের মতো মন লাগে না। অত যে চা খেতে ভালোবাসতেন, দিনে আট-দশ কাপ, সেই চা দেখলে এখন তার গা বমি দেয়।
টুথব্রাশে পেস্ট লাগাতে গিয়ে প্রায়শই শেভিংক্রিম লাগিয়ে দাঁতে ঠেকিয়ে ওয়াক্ থুঃ করছেন। বাড়িতেও কথাবার্তা বলা কমিয়ে দিয়েছেন। কোনো রকমে ডিউটিটা করছেন।
প্রথম সপ্তাহটা ভালোভাবে কাটল। রোববারের দিনটা মাংসের ঝোল, আলুপোস্ত আর বিউলির ডাল দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সেরে দু-ঘণ্টা ছাঁকা ঘুম দিলেন। সোমবার সকালে মর্নিংওয়াকে বেরিয়ে দ্বাদশ মন্দিরের দিকে তাকাতেই দেখলেন সেই দাড়িওলা ফুলছাপ হাওয়াই শার্ট পরা লোকটা দাঁড়িয়ে।
আজ আবার হাতে একটা হকিস্টিক। এই প্রথম সত্যিকারের ভয় পেয়ে গেলেন ডাকসাইটে দারোগা শ্রীমন্ত দত্ত। ঠিক করলেন মন্দিরের দিকে না গিয়ে ডানদিকে রাধাকান্ততলার পাশ দিয়ে ঘুরপথে মিশনমাঠে যাবেন। হাঁটা নিয়ে কথা, তা সে যে পথ দিয়েই হোকনা কেন। ধার থাকা ভালো নয়
শ্রীমন্ত দারোগা হাঁটছেন। টি-শার্ট, হাফ-প্যান্ট আর কেড্স জুতোয় যথেষ্ট সাহসী এবং স্মার্ট হবার চেষ্টা। নার্ভাসনেস কাটানোর জন্য বেশ চড়া গলায় গান ধরলেন।— “আমি ভয় করব না ভাই, করব না; দু-বেলা মরার আগে মরব না, ভাই মরব না.......
বিধির বিধান কে খণ্ডাবে! রাধাকান্ততলা পার হয়ে বিবেকানন্দ স্কুলের গেটের সামনে এসেছেন কী আসেননি, আবার সেই লোকটা। বসাকদের আইসক্রিম কলের সিকিউরিটি গার্ডের সঙ্গে গল্প করছে। শ্রীমন্তকে দেখেই চোঁ চোঁ দৌড়।
শ্রীমন্ত দারোগা বুঝলেন লোকটা ভয় পেয়েছে। এতদিন ভেবে আসছিলেন লোকটা বদ মতলবে এসে ওঁকেই ভয় দেখাচ্ছে। আজ ওঁর চোখ খুলল। লোকটাকে বেপাড়ার কুকুরের মতো লেজ গুটিয়ে পালাতে দেখে তাঁর সাহস ফিরে এল।
মনে মনে ভাবলেন, আজ একটা হেস্তনেস্ত, একটা এসপার ওসপার করেই ছাড়ব। হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলেন। এখন তাঁর ভয়ডর ঘুচে গেছে। এতদিন ভাবছিলেন লোকটা ওঁকে ওয়াচ করছে। আজ পরিষ্কার বুঝতে পারলেন লোকটা ভয় পেয়ে আড়ালে যেতে চাইছে। ধার থাকা ভালো নয়
অনেক চেষ্টা করেও লোকটাকে কখনো দেখেছেন বলে মনে করতে পারলেন না। অবশ্য দূরের থেকে মুখটাও ভালো ঠাহর করতে পারছেন না। তার ওপর গালভর্তি মৌচাকের মতো দাড়ি। তবে হাঁটার ভঙ্গিটা খুব চেনা চেনা মনে হল। শ্রীমন্ত যেন চোখের পলকে একমাস আগের শ্রীমন্ত হয়ে গেলেন।
যেন আড়াইসিকি থানার দারোগা পদামস্তানের চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাচ্ছেন। ঠিক করে ফেললেন যেভাবেই হোক লোকটাকে ধরতে হবে। দীপক বিষ্ণুর বাড়ির গলিটা টপকাতে গিয়ে দেখলেন ব্যাটা গুটিসুটি মেরে অম্বিকা সর্দারের পানগুমটির পেছনে মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
শ্রীমন্ত সামনে আসতেই আবার দৌড়। ‘থাম, থাম, গুলি করব' বলে হাতের কুকুর তাড়ানোর লাঠিটাকে রিভলবারের মতো তাগ করে পেছন পেছন ছুটলেন। তাড়াহুড়োতে লোকটা পড়ল ড্রেনের মধ্যে।
উঠে পালাবার আগেই ঘাড়ের ওপর শ্রীমন্ত দারোগার সলিড রদ্দা। লোকটা কুঁই কুঁই করে দারোগাবাবুর পা-দুটো জড়িয়ে ধরল। —কে রে তুই? ব্যাটা নচ্ছার পাজি শয়তান, ইয়ার্কি মারার জায়গা পাসনি।
আমার সঙ্গে টক্কর দিবি? কেউ পারল না, আড়াইসিকি থানার দেড়সিকির দারোগা হরিনিবাস পারল না, তুই তো কোথাকার ছারপোকা। কী নাম তোর?
—আজ্ঞে স্যার, বলছি দাঁড়ান। জামাটা ছাড়ুন, ঘাড়ে বড্ড ব্যথা লাগছে। দু-এক দিনের মধ্যেই দিয়ে দেব স্যার। সত্যি বলছি, স্যার। আর ভুল হবে না। ধার থাকা ভালো নয়
একটু অসুবিধার মধ্যে পড়ে গেসলাম স্যার। এবার কাটিয়ে উঠেছি। এই কাল পরশুর মধ্যে, ধরুনগে স্যার বুধবারের মধ্যে, মিটিয়ে দেব।
—কী উলটো পালটা বকছিস। মাথায় ছিট আছে নাকি! জিজ্ঞেস করলাম নাম, আর তুই তার উত্তরে হাবিজাবি বকছিস। বলি কী দিয়ে দিবি বলছিস শুনি।
—বুঝতে পারছি, স্যার। অনেকদিন হয়ে গেল। কথার খেলাপ ভালো নয় জানি। নেহাত আপনার মতো মহানুভব বলে পার পেয়ে গেলাম। দু-একটা দিন সময় দিন, স্যার। —বুঝলাম না কী বলতে চাইছিস।
তোকে তো আমি চিনিই না। আগে কখনো দেখেছি বলেও মনে হয় না। কদিন ধরে দেখছি পাড়ায় ঘুরঘুর করছিস। আমাকে চোখেচোখে রাখছিস। সামনে পড়লে পালাবার ধান্দা করছিস। কে তুই ?
শ্রীমন্ত দারোগা লোকটার চিবুক ধরে মুখটা উঁচু করতে গিয়েই ঘটল এক কাণ্ড। কালো কুচকুচে চাপদাড়িটা তার ডান হাতের মুঠোয় চলে এল। ধার থাকা ভালো নয়
লোকটাও ভ্যাঁ করে কেঁদে পা-দুটো জড়িয়ে বলল – আমাকে ছেড়ে দিন, স্যার। আর কক্ষনো আসব না আপনার থানার চৌহদ্দির মধ্যে। কালকেই আপনার একশো টাকা দিয়ে দেব। ধার থাকা ভালো নয়।
—তুই ছিদাম না? তাই তো বলি, চলন-বলনটা কেমন যেন চেনা বলে ঠাহর হচ্ছিল। এখন মনে পড়ছে, আড়াইসিকি থানার সামনে তোর চায়ের দোকান ছিল।
একশো টাকা ধার নিয়েছিলি পরিবারের অসুখ বলে। অ্যাদ্দিনে খেয়াল হল। তা কে পাঠিয়েছে তোকে এখানে? নিশ্চয় কেউ পাঠিয়েছে।
—আজ্ঞে স্যার, হরিনিবাস দারোগা ক'দিন থেকে পেছনে জোঁকের মতো লেগে আছেন। রোজই বলছেন, শ্রীমন্তর থানায় কোনো গণ্ডগোল নেই। কিছু চোর-বদমাশকে আপনার থানায় চালান করার জন্য আমাকে লাগিয়েছিল।
আমি স্যার, পদা, ভোম্বল, জগা, নুলো, পচা এদের সঙ্গে কথা বললাম, কেউই রাজি হল না। আপনাকে সবাই দেবতা বলে মানে। আমিও মানব স্যার। কথা দিলাম। আর আপনার একশো.......।
থাক। ওটা আর দিতে হবে না। তুই এখানে থেকে যা। তোকে একটা পোলট্রি করে দেব। বেশ ডিম আর মাংস খাওয়া যাবে। হরিনিবাসকে কীভাবে টাইট দেওয়া যায় ব্যবস্থা করছি।
মাসখানেক কেটে গেছে। শ্রীমন্ত দারোগা এখন বেশ ভালো আছেন। ভুঁড়িটা শান্তির জল পেয়ে আবার ফুলে ফেঁপে উঠেছে। তাঁর আর মনে কোনো ভয়ডর নেই। ধার থাকা ভালো নয়
আবার দিনে আট-দশ কাপ চা খাচ্ছেন। কোনো টেনশন নেই। মোট কথা শ্রীমন্ত দারোগা এখন বহাল তবিয়তে আছেন। Dhar thaka Valo noi.Dhar thaka Valo noi, Dhar thaka Valo noi Dhar thaka Valo noi
নিত্য নতুন সকল আপডেটের জন্য জয়েন করুন
If any objections to our content, please email us directly: helptrick24bd@gmail.com